মুক্তকথা (পর্ব ৩-৮)

0
617

নিয়মের বাইরে অন্য এক অভিযান, ডালপুরি আর স্বদেশী আন্দোলনের স্বপ্নপুরী

সময়টা ১৯৬৮, দেশ পত্রিকায় একটা ধারাবাহিক লেখা লিখছিলেন একজন গবেষক-লেখক। তিনি বাংলার নানা সাংস্কৃতিক জায়গার কথা লিখতে গিয়ে দক্ষিণ বঙ্গের বহরু জায়গার কথা উল্লেখ করেন। জয়নগরের পরে এই জায়গাটি। ওখানে এক প্রাচীন জমিদার বাড়ির ধ্বংসাবশেষ আছে যেখানে এখনো তাদের বংশধরেরা বাস করেন। তাদের নাট মন্দিরের দেওয়ালে পঙ্খের মাধ্যমে আঁকা দেওয়ালচিত্রটি সম্পূর্ণ রাজস্থানি আঙ্গিকের। বাড়ির চারপাশে ঝোপঝাড় ভর্তি। মনে হয় একসময় সাতমহলা বাড়ি ছিল। লেখাটা রতন আমার নজরে আনে। আমি ওকে বললাম সবাই মিলে একবার ঘুরে আসলে কেমন হয়? ও তৎক্ষণাৎ রাজি, বললাম সবাই বলতে কলেজে যারা যারা উৎসাহী তাদের নিয়েই যাবো, সারাদিন ছবিও আঁকা যাবে, ওখানেই খাওয়া দাওয়ার একটা ব্যবস্থা করে নিতে পারলে সারা দিনই কাটাতে আসুবিধে হবে না। রতন রাজি হয়ে গেলো প্রাথমিক খোঁজ খবর নিয়ে আসার জন্য।

কলেজে রটে যেতে বেশি সময় লাগলো না। অনেকেই নাম লেখাতে শুরু করলো, জুনিয়র ক্লাস থেকে সিনিয়র ক্লাস অবধি। ছাত্রীদের মনে হয়তো নানা সংকোচ ছিল। তারা আর আমাদের সঙ্গে যেতে ভরসা পায় নি। পরে দেখেছি তাদের আফসোস করতে। আসলে কলেজে আমি নানাভাবেই বিতর্কের কেন্দ্রে থাকতাম, এমন বিতর্কিত ছেলেদের এড়িয়ে নিজের ক্যারিয়ারে মন দেওয়া অনেক নিরাপদ।

সকালের কলা ডিম পাউরুটির ব্যবস্থা করে নিলাম যাতে পৌঁছেই আমরা ক্ষুধার্ত বোধ না করি। সবাইকে শিয়ালদহ স্টেশনে আসতে বলা হয়েছে। দেখলাম সিনিয়রদের মধ্যে অনেকেই আগেভাগে চলে এসেছেন যেমন বিমান বিহারী দাস, কালীদাস কর্মকার। বাকিরাও সবাই সময়মতো পৌঁছে যেতেই আমরা রওনা হলাম। অচিরেই আমাদের গন্তব্য স্থানের স্টেশনে পৌঁছে গেলাম আমরা প্রায় বিশ জন। সেখান থেকে হেঁটে প্রায় অনেকটাই মেঠোপথ ধরে সেই বাড়ি মানে বসুদের বাড়ি আমরা পৌঁছলাম। রাস্তায় আমাদের এতজনকে দেখে অনেকেই নানারকম ভাবতে শুরু করে দিলো। কেউ ভাবলো শুটিং করতে এসেছি, কেউ ভাবলো পিকনিক করতে। আর দিনকাল ভালো যাচ্ছে না, গ্রামের মানুষদের কাছে শহরের এতগুলো অল্প বয়েসের ছেলে মানেই নকশাল। তার উপর আমাদের মধ্যে কেউ কেউ নতুন ফ্যাশন শুরু করে দিয়েছে ফুলপ্যান্টের সঙ্গে পাঞ্জাবি পরা। এমন পোশাক সম্ভবত আমরাই সেদিন শুরু করলাম। দূর থেকেই বিশাল বাড়িটা আমাদের সবাইকে মোহিত করে তুললো। রতন আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিল। বাড়ির বর্তমান কেয়ারটেকার বেশ আহ্লাদিত আমরা এতজন আসাতে। তিনিই আমাদের সারাদিন দেখাশোনা করবেন, রান্নার দায়িত্বও নিয়েছেন লোকজন জোগাড় করে। আমরা প্রথমেই সেই পঙ্খের কাজ করা দেওয়ালচিত্র দেখতে নাটমন্দির গেলাম। কিছুটা রং চটে গেলেও বুঝতে অসুবিধে হয় না যে কতটা উন্নত মানের কাজ হতো এত বছর আগে। স্থানীয় জমিদারদের রুচির একটা পরিচয় পাওয়া যায়। যদিও তারা মুঘল বাদশাহদের অনুকরণ করতে ভালোবাসতো, এই কাজ বেশ একটা কঠিন পদ্ধতি যা বেশিরভাগ রাজস্থান অঞ্চলের শিল্পীরা করতেন ওখানকার বিত্তবানদের বাড়িতে বা মন্দিরের গায়ে। পশ্চিমবঙ্গে এ-ধরনের কাজ বিশেষ দেখা যায় না।

আমরা বাড়ির চারপাশ ঘুরে দেখার সময় দেখছি বড়ো বড়ো থামগুলো অতীতের অহংকারকে এখনো বয়ে নিয়ে চলেছে। চারপাশে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল। আমাদের আগেই সাবধান করে দিয়েছিল যে জঙ্গলে অজগর সাপ আছে। অনেকেই ভয়ে বাড়ির ছাদে উঠে চারপাশের প্রকৃতিকে নিজের সঙ্গে আনা রং-তুলিতে কাগজে ভরিয়ে তুলতে থাকলো আপন মনের উচ্ছ্বাসে। আমি কিন্তু ওই জঙ্গলে গিয়েই ছবি আঁকলাম। কেউ আমায় বিরক্ত করে নি।

সেদিন সারাদিন ওখানে আমাদের সকলেই খুব ঋদ্ধ হলো। আর আমরা সিনিয়র-জুনিয়র সব এক হয়ে আরও ঘনিষ্ঠ হলাম। ফিরে এসে সকলেই এর আলোচনায় মগ্ন। যারা যায়নি তারা আফসোস করছে। এমন আবার কবে হবে তার জন্য এখনই তদারকি শুরু করে দিলো কয়েকজন।

কলেজে আমি একটা বার্তা দিলাম, আমরা যদি কারো প্ররোচনায় না আসি তবে এভাবেই শিল্পকে আমরা ভালোবাসতে পারবো। কলেজ-রাজনীতি বড়ো ভয়ংকর। কাউকে রেয়াত করে না। আমি যে বেপরোয়া সেটা ততদিনে সবাই জেনে গেছে। না হলে চিন্তামনি করের হুশিয়ারিকে তোয়াক্কা না করে অ্যাকাডেমিতে যাতায়াত করতে পারে! কলেজ কর্তৃপক্ষকে তোয়াক্কা না করে সবাই মিলে এভাবে ঘুরেও আসতে পারে! অনেকের কাছেই ছিল একটা ঘোর। আসলে কলেজ এক্সকার্শন ছাড়া এসব ভাবতেই পারা যায় না।

আমাদের অধ্যক্ষ মূলত ভাস্কর, হেনরি মুরের সাক্ষাতে কাজও করেছেন, কিন্তু তিনি মূলত শিক্ষা পেয়েছেন অবনীন্দ্রনাথের ওরিয়েন্টাল আর্ট সোসাইটি থেকে। সাহেবের মতো দেখতে, সাহেবদের মতো কোট-টাই পরে থাকতে ভালোবাসতেন। উনার দু’একজন অন্ধ ভক্ত ছাত্রও ওই পোশাকে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। আমিনা কর উনার সহধর্মিণী একজন উঁচু মানের শিল্পী, কিন্তু তার স্বামীর দৌলতে আজীবন প্রদীপের নিচে কাটিয়ে দিলেন। দেশ পেল না একজন বড়ো মাপের শিল্পীর থেকে আরও কাজ। উনাদের এক সন্তান ছিল জন্মকাল থেকেই প্রতিবন্ধী। মা তাকে সামাল দিত। বিকেল হলে দেখতাম এক আয়া ছেলেটিকে নিয়ে ধরে ধরে কলেজের বাগানে ঘোরাতে। পরিবারটি কেমন যেন আনন্দহীন এক অভিশপ্ত সময়ের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে গেলো। শেষ জীবনটা ওদের তিনজনের আলাদা আলাদাভাবে খুব নিঃসঙ্গতার মধ্যে শেষ হয়েছে শুনেছি।

অধ্যক্ষ আমাকে কোনোদিন সন্তানস্নেহে দেখতে পারেন নি। কেমন যেন ভাবতেন এ-এক কৃষ্ণ এসেছে কংসকে ধ্বংস করতে। আসলে ততদিনে আমি জেনে গেছি, এই অধ্যক্ষ পদটি যারাই সামাল দিয়েছেন তারাই নিরপেক্ষতায় কৃপণ ছিলেন। সে-নিয়ে পরে বলা যাবে। শুধু বলছি, এখান থেকে শুধু ভারতের সেরা শিল্পীরাই বেরোয়ই নি, তারা রীতিমতো আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতকে উঁচু স্থানে রাখতে সমর্থ হয়েছিল। ভারতে শিল্পের রেনেসাঁ এই বঙ্গ থেকেই ঘটেছিল। তাদের অনেককেই নানা ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। তার মধ্যে অধ্যক্ষদের অসহযোগিতা ছিল তাদের জীবনে এক বড় বাধা অথবা আশীর্বাদ।

আমার সৌভাগ্য দুই ঐতিহ্যসম্পন্ন প্রতিষ্ঠানে একই সঙ্গে চরাচর করে যেতে পারছি। আমাদের শৃণ্বন্তু তার শাখা-প্রশাখা মেলে এগিয়ে চলেছে একইভাবে।

রতন থাকতো প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মুখে বৌবাজার স্ট্রিটের উপরে এক বাকসো ধরনের চারতলা বাড়ির চার তলায়। ওখানে ওর বাবার স্টুডিয়ো ছিল। তিনি নিজে একজন ভালো কমার্শিয়াল আর্টিস্ট ছিলেন। কর্মরত ছিলেন ক্লারিয়নে। রতন এখানেই থাকতো, কলেজ যেতে সুবিধে হবে তাই। ওদের বাড়ি উল্টোডাঙ্গাতে। রতনের কাছে কলেজের আরও এক ছাত্র থাকতো। সে এসেছে ত্রিপুরা থেকে, নাম স্বপন নন্দী। সেও এই কলেজের, তবে সে ক্রাফট বিভাগে ছিল। ভালো জল রঙের ছবি আঁকতে পারদর্শী। আমরা শলা-পরামর্শ করতাম সবই এখানে। আর প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটের মুখেই ছিল প্রখ্যাত সুরকার গায়ক রাইচাঁদ বড়ালের প্রাসাদোপম বাড়ি, এখানেই আমরা শৃণ্বন্তুর নানা সাহিত্য ও শিল্পের সভা বসাতাম। তাছাড়াও মাঝে মাঝে মার্বেল প্যালেসের ভিতরে ও অন্যান্য জায়গায় আমাদের আলোচনা সভা বসত।

রতনের বাড়ির নিচেই পাওয়া যেত সেই বিখ্যাত ডালপুরি, আর পাশেই ছিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠন-এর শহিদদের ছবি টাঙানো ফটোগ্রাফির দোকান যার মালিক নিজেও ছিলেন অনুশীলন সমিতির একনিষ্ঠ সদস্য। আমি মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে সময় নিয়ে দেখতাম। চোখের সামনে ভেসে উঠতো সেই অভিযান, যেন আমিও আছি। আমাদের সঙ্গে কলেজে পড়ে স্বাধীন লালা যে বোহরু যাত্রার সময়ে ছিল। ওদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ছিলেন লোকনাথ বল ও অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের কনিষ্ঠতম সদস্য টেগড়া। ওদের বাড়িতে ওর মায়ের কাছ থেকে সেই সময়ের গল্প শুনতাম। ওদের বাড়িতেও তাঁদের ছবি আমি দেখেছি। ফলে এই দোকানে এলেই সেই গল্প সামনে ভেসে ওঠে। পাশের দোকান থেকে ডালপুরি খেয়ে পাশেই স্বদেশী আন্দোলনকারীদের ছবি দেখে অনুপ্রাণিত হতাম।

আমাদের বহোরু যাত্রা ও সেই বসু বাড়ির মহল

 ৪

কিংবদন্তিদের সঙ্গে ছন্নছাড়ারা

শৃণ্বন্তুর সদস্য সংখ্যা অনেক বেড়ে গেলো। একদিকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের জন্যে চারিদিকে এক অস্থির পরিবেশ, তারমধ্যে আমরা সুষ্ঠু সাহিত্য ও শিল্পের জন্য তরুণ ছেলেমেয়েদের একত্রিত করছি। কলেজের শিক্ষকরাও আমাদের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন নানাভাবে। আমাদের মধ্যে মাঝে মাঝেই নিয়ে আসছি বিশিষ্টজনদের। সুনীল গাঙ্গুলীর আত্মপ্রকাশ সবাইকে মুগ্ধ করেছে, ওর কবিতাও আমরা নিয়মিত পড়ছি। আমি সরাসরি আনন্দবাজারে গিয়ে সুনীলদাকে আমাদের কথা বললাম। আর্জি জানালাম আপনাকে আসতে হবে এবং আমাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে কবিতা শোনাবেন। বড়াল বাড়ি বলে একটা সুবিধে ছিল, ইতিহাসে বড়াল বাড়ির নাম তখন সবার জানার মধ্যে, ফলে এখানে আসতে সচরাচর কেউ আপত্তি করতেন না। আমরা সবাই ওই বাড়ির একতলায় এক বড় ঘরে কার্পেটের উপর বসতাম। নিমাই বড়ালের ছেলে নির্মলদা আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন আন্তরিকতার সঙ্গে, আর উনার জন্যও পাড়ার অনেকই আমাদের সঙ্গে চলে এসেছে। সুনীলদা এলেন, অনেকক্ষণ নিজের কবিতা পড়লেন এবং আমাদের নানা কৌতূহল মেটালেন। এভাবেই একদিন গণেশ হালুইকে এনেছিলাম শুধুমাত্র উনার অজন্তার অভিজ্ঞতা শুনতে। অজন্তায় তিনি অনেকদিন থেকে গুহার দেওয়ালচিত্রের খুঁটিনাটি জেনেছিলেন। সেই অভিজ্ঞতা তিনি সবার সঙ্গে ভাগ করলেন, আমরাও ঋদ্ধ হলাম। বহু কষ্টে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কে পেয়েছিলাম, উনার এক ছাত্রের সুবাদে যে তখন আমাদের সঙ্গে যুক্ত ছিল। আমরা ওর পটলডাঙ্গার সেই বিখ্যাত বাড়িতে গিয়ে উনাকে বারবার বলাতে আসতে রাজি হলেন। আপাত গম্ভীর, সৌম্যকান্তি কিন্তু আগাগোড়া রসে ভরা মানুষটি সেদিন শুধু ছোট গল্প নিয়ে বললেন আর নিজের গল্প ‘টোপ’ পড়লেন ওঁর বই থেকে। আমাদের সঙ্গে রসসাহিত্য বিশেষ করে টেনিদা নিয়ে সেদিন আর আলোচনা হল না সময়ের অভাবে। তাই সেদিন টেনিদার স্রষ্টাকে পেয়েও আমাদের মন ভরলো না।

আমাদের আলোচনার আসরের ব্যাপারে সবাই জেনে গেছে। অনেকেই আসতে চাইছেন। একবার মার্বেল প্যালেসে কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তীকে আমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা হলো। সেদিন অনেক ভিড় হিয়েছিল উনার কবিতা শোনার জন্য। ওই সময় গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দিয়ে আমাদের কলেজে দারুণ এক প্রদর্শনী হয়। তখন আলাপ হয় উনার নাতি দ্বারিকানাথ চ্যাটার্জির সঙ্গে। তিনি নিজেও এক গুণী শিল্পী, প্রতিদিন আসতেন প্রদর্শনী কক্ষে, অনেক কথা শুনতাম উনার স্মৃতি থেকে। গড়িয়াহাট অঞ্চলে থাকতেন। উনি চাইলেন উনার বাড়িতে যেনো একদিন আমাদের সভা হয়। আমরা খুব খুশি মনে রাজি হয়ে সত্যেন ঘোষাল স্যারকে আমন্ত্রণ জানালাম বলবার জন্য। সেদিন দ্বারিকাবাবুও বলেছিলেন ঠাকুরবাড়ির শিল্পচর্চা নিয়ে।

আমাদের কাজকর্ম সম্পর্কে কিভাবে যেন ও সি গাঙ্গুলী জেনেছিলেন। আমাকে কাঁপা কাঁপা হাতে একটা পোস্টকার্ড লিখে পাঠিয়েছিলেন, অনেক কষ্টে পড়তে পেরেছিলাম। তিনি চান উনার সঙ্গে দেখা করতে একদিন ওঁর বাড়িতে যাই। আমি ও রতন চলে গেলাম ওঁর এলগিন রোডের মুখে শম্ভুনাথ পণ্ডিত রোডের শুরুতে এক বড় বাড়িতে।  সেখানে এখন অন্যকিছুর ব্যবসা গড়ে উঠেছে। তখন এসব ছিল না। তিনি দোতলায় থাকতেন। আধো অন্ধকার ঘরে তিনি এক আরাম কেদারায় বসেছিলেন। চশমার কাচ প্রায় আতস কাচকে ছাড়িয়ে গেছে, ঘরে ধুলো জমে গেছে, বোঝা যায় যত্নের কোথাও অভাব, পাশে হাজার হাজার স্লাইড পড়ে আছে একটা কাঠের খোলা বাক্সে, এদিক-ওদিক ছড়ানো নানা শিল্পবস্তু। আমি ততদিনে উনার সম্পর্কে অনেকটাই পড়াশোনা করে ফেলেছি, বিশেষ করে অমৃত পত্রিকায় তখন উনার আত্মজীবনী নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে। আমাদের দেখে বললেন, তোমরা তো শিল্পের জন্য সভা করছো, আমার বাড়িতে একদিন করো; আমি তো কোথাও আর যেতে পারি না, যাবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছি, এখনকার শিল্প সম্পর্কে জানতে চাই, কী চলছে। আমরা সেদিন বাকরুদ্ধ ছিলাম। এক ইতিহাসের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, উনাকে আমরা আর কী জানাবো! আমি বললাম নিশ্চয় একদিন আমরা সবাই আপনার কাছে আসব, কথা দিলাম। কথা আমরা রেখেছিলাম। বিজন চৌধুরী তখন অনেক কথা লিখছেন ও বলছেন শিল্প নিয়ে। তিনি তখন বিড়লাদের এক কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সমকালীন শিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি বেড়েছে।

কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সমকালীন শিল্পী হিসেবে তাঁর পরিচিতি বেড়েছে। খোঁজ করে উনাকে রাজি করালাম বর্তমান শিল্পের হালহকিকত নিয়ে বলার জন্য। ও সি গাঙ্গুলির বাড়িতে সবাই সমবেত হয়ে একদিন আমরা তাঁর মুখ থেকে শুনলাম আমাদের দেশের শিল্পের ভবিষ্যৎ শুধুমাত্র বিদেশিদের দাক্ষিণ্যের উপর নির্ভর করছে, দেশীয় মানুষের মধ্যে শিল্প-চেতনাটাই গড়ে ওঠে নি, যতদিন না সাধারণ মানুষ একে ভালোবাসবেন ততদিন শিল্পের ভবিষ্যৎ অন্ধকারেই থাকবে। বিদেশিরা ছবি কিনে অনেক সময় এখানেই ফেলে চলে যান, সে-কথাও জানান দিলেন।

ও সি গাঙ্গুলী সব শুনে বললেন, তাহলে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, গগনেন্দ্রনাথ ঠাকুর ওরিয়েন্টাল স্কুলের শিল্পীরা কিছুই করতে পারে নি? সবাই চুপ ছিলেন। বিজনবাবুই বললেন, ওঁরা দেশীয় শিল্পের ভিতটা গড়ে দিয়েছেন বলে আমরা এখন শিল্পের একটা রাস্তা বার করতে পারছি। আধুনিক শিল্পের ভিত মানুষের মধ্যে এখনও গাঁথা বাকি আছে। আপনারই তো পথ প্রদর্শক, আপনারা পথ না তৈরি করলে আমরা কোথায় থাকতাম!

সেদিনের এই আলোচনা আমাদের অনেক কিছু শিখিয়ে দিল। বেঙ্গল স্কুল ও সমকালীন আধুনিক শিল্পের ভিত্তি ও তার বর্তমান পরিস্থিতি আমাদের মতো উঠতি শিল্পীদের মাথায় অনেক ভাবনা ঢুকিয়ে দিল।

নীতিপুলিশের পরামর্শে অধ্যক্ষের নির্দেশে কলেজে এই অশ্লীল পত্রিকা বিক্রির নির্দেশিকা

সাইক্লোস্টাইলে শিল্প পত্রিকা

সময়টা চলছে সেই ১৯৬৮, ১৯৬৯। শৃণ্বন্তুতে ভালো ভালো শিল্প আলোচনা আমরা করছি, কিন্তু সেটা সবাই জানতে পারছে না। ঠিক হলো কম খরচে শিল্প পত্রিকা বের করার, সুন্দরম করার সাহস ও ক্ষমতা কোনোটাই নেই। আমরা রঘুনাথ গোস্বামীর কাছে যাবার প্রস্তুতি নিলাম। ওঁর সঙ্গে আগেই আলাপ ছিল, অসুবিধা হয় নি। হেস্টিংস স্ট্রিটের ৬ নম্বর বাড়িতে ওঁর স্টুডিয়ো, ওখানে ছোট একটা পুতুলনাচ করার জন্য একটা স্টেজ সবসময় থাকতো, পুতুল নাচের চলচ্চিত্র করে ইতোমধ্যে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। একসময় আমি অন্নদা মুন্সীর কাছে কিছু জানার জন্য যখন যাই, বলেছিলেন রঘুনাথকে ধরে থাকো, অনেক কিছু পাবে। হ্যাঁ পেয়েছিলাম, অনেক আধুনিক চিন্তাভাবনা, তার সঙ্গে মনোবল। একদিন উনার দমদমের বাড়িতে আমাদের আমন্ত্রণ করলেন পুতুলনাচ দেখাবেন আর শিল্প নিয়ে আড্ডা হবে। আমরা ততদিনে প্রকাশ কর্মকার, বিপিন গোস্বামী, রবীন মণ্ডল এনাদের সঙ্গে ভালো রকমের মেলামেশা শুরু করে দিয়েছি। উনাদেরও আমন্ত্রণ জানাতে রাজি হলেন। সে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা, এতজন শিল্পীর সঙ্গে আমরাও রয়েছি। রঘুদা অনেক আলোচনা করলেন সবার সঙ্গে। বললেন, এরা মনে হয় অনেক স্বপ্ন দেখছে, চলুন আমরা এদের সঙ্গ দেই। সবাই খুশি রঘুদার অ্যাপায়নে আর পুতুলনাচ দেখে। বাকিটা আমাদের সঙ্গে আলোচনা করে অনেক কিছুই ঠিক করা হলো। শিল্পীরা যেন সাধারণ মানুষের জন্য কম দামে ছবি বিক্রি করতে পারেন, সে-উদ্দ্যেশ্যে আর্ট ফেয়ার করা নিয়ে ভাবনা-চিন্তাও শুরু হয়ে গেলো।

আমরা রঘুদার অফিসেই বসে ঠিক করলাম সাইক্লোস্টাইল মাধ্যমে পত্রিকা প্রকাশ করার। নাম তিনিই ঠিক করে দিলেন প্রমিতি। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ তিনিই মোমকাগজে সরু সূচের মতো পেন দিয়ে এঁকে দিলেন, আমরা কার্বন কপিটা দেখলাম। শুরু হলো প্রমিতির কাজকর্ম। শ্রদ্ধানন্দ পার্কের কাছে মির্জ্জাপুর স্ট্রিটের উপর এক দোকানে হাতে ঘোরানো এই মেশিন ছিল। তাতে ছাপিয়ে নিয়ে নিজেরাই বাঁধিয়ে মানে স্টাপল করে নিতাম। তারপর কাটাই মেশিন থেকে কেটে হয়ে যেত পত্রিকা। সেন্টার স্টিচ ছিল, তার জন্য একটা কঠিন হিসেব থাকতো, নয়তো পাতা এদিক-ওদিক হয়ে যাবে। এই পরিশ্রমটুকু তখন কিছুই মনে হতো না। ভালো একটা কাজ করছি, এটাই ছিল প্রেরণা।

আমরা কলেজেই হাতে হাতে বিক্রি করছি, প্রথম সংখ্যাতে রতন ব্যানার্জীর একটা স্কেচ ছিল, যা নিয়ে কেউ হয়তো চিন্তমনি করের কানে তুলে বলেছিল এসব কী করছে, সব অশ্লীল ছবি কলেজে বিক্রি করছে, এখনই বন্ধ হওয়া উচিত। চিন্তামনি কর হটাৎ করে সেই নীতিপুলিসের কথায় কলেজে পত্রিকাটি বন্ধ করার হুকুম জারি করলেন। অগত্যা আমরা গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে পত্রিকা বিক্রি করলাম। মুহূর্তে সব বিক্রিও হয়ে গেলো। কলেজেই এর এত চাহিদা বাড়লো যে বেশি করে ছাপা শুরু করলাম। দাম ছিল চার আনা। দু’একদিনের মধ্যে যুগান্তর পত্রিকায় বড়ো করে ছেপে দিল রতনের এই স্কেচ, সঙ্গে অনেক তারিফ। ফলে ক্রমশ এর চাহিদা বাইরে ছড়িয়ে পড়লো। গণেশ পাইন নিয়মিত ছোট বিজ্ঞাপন দিতেন। এতে দু’তরফের উপকার হতো: প্রথমত আমাদের, আর দ্বিতীয়ত বিজ্ঞাপনে উল্লেখ থাকা ফুটপাথে তুলি বিক্রি করা এক ব্যক্তির, যিনি জ্যোতি সিনেমার উল্টোদিকের ফুটে বসে তুলি বিক্রি করতেন। সোসাইটির অনেকেই নানাভাবে আমাদের সহযোগিতা করে গেছেন, যা আমাদের কাছে অভাবনীয় লেগেছে।

আর এই পত্রিকা দেখে কর্পোরেশনের এক সংস্কৃতিমনস্ক ঠিকাদার নাম বেচারাম ঘোষ, যিনি পরবর্তী সময় আমার জীবনের এক ঘনিষ্ট বন্ধু হয়ে উঠেছিলেন, প্রস্তাব করলেন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে তাঁদের ঠিকাদার এসোসিয়েশনের মুখপত্র প্রকাশ করে দিতে। আমরা করে দিয়েছিলাম। উনাদের কথা পরে বলবো আরও।

ধীরে ধীরে অনেকেই যুক্ত হতে শুরু করলেন। আনন্দবাজার পত্রিকার অহীভূষণ মালিক সমকালীন শিল্পীদের নিয়ে তাদের কাজ ও জীবন যাত্রা নিয়ে নিয়মিত লিখছেন আনন্দবাজার পত্রিকাতেই। আমরা উনার সঙ্গে গিয়ে আলাপ করলাম, তিনি অনেক সাহায্য করবেন ভবিষ্যতেও।

হাতের লেখা ছিলো শুভাপ্রসন্নর, ছবি এঁকে দিতেন গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য প্রকাশ কর্মকার, দ্বারীকানাথ চ্যাটার্জী, আহিভূষণ মালিক, চন্ডী লাহিড়ী। আমি নিজেও ছদ্মনামে লিখতাম ও আঁকতাম, লিপিকা গুপ্ত ছিল সেই নাম।

আমাদের প্রতিটি সংখ্যাই সকলের মধ্যে জনপ্রিয় হতে লাগল। পরে মূল প্রেসে ছাপা হয়ে বেরোতে থাকে। তবে সাইক্লোস্টাইল পত্রিকা প্রসঙ্গে অমৃত পত্রিকার এক সমালোচক বলেছিলেন এই পত্রিকার প্রতিটি পাতাই গ্রাফিক চিত্র হিসেবে গণ্য হওয়া উচিত।

অ্যাকাডেমিতে লেডি রাণুর খুব ভালো লাগতো। তিনি নিজে এসেই চেয়ে নিতেন, আমার কপি কোথায়? তখন অ্যাকাডেমি থেকে একটা বুলেটিন প্রকাশ হতো অনিয়মিতভাবে।

আমরা কলেজের পর নিজেদের প্রয়োজনে হাওড়া বা শিয়ালদহ স্টেশনে স্কেচ করতে যেতাম, এটা প্রায় নিয়মিতই ছিল। অন্য সময়ে কিছু বাণিজ্যিক ছবি আঁকার কাজ করতাম যেগুলো না থাকলে কলেজের খরচ চালানো মুশকিল ছিল। এর মধ্যে ছিল বেতার জগৎ-এর প্রচ্ছদ বা ইলাস্ট্রেশন, কলেজ স্ট্রিটের বই পাড়া অঞ্চলের প্রকাশকদের বইয়ের প্রচ্ছদ ইত্যাদি। তবে বাণিজ্যিক কাজের প্রতি আমার আগ্রহ তেমন ছিল না, নিজের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করে নিয়ে প্রতিনিয়ত চলতে হতো। আমার মতো সমস্যা আমি অন্য কারোর মধ্যে দেখি নি। বন্ধুরা বুঝতে পেরে অনেক সময় আমাকে না জানিয়ে সাহায্য করতো, যা আমি পরে টের পেতাম।

সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে করা প্রমিতির কিছু ছবি

সাইক্লোস্টাইল পদ্ধতিতে করা প্রমিতির কিছু ছবি

আকাশকুসুম কল্পনা

সবকিছু সামলেই আমার সাংস্কৃতিক কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছি। জানি সামনে অনেক লড়াই আছে, অনেক পরিশ্রম করতে হবে। আমরা সব কিছুর পর সন্ধ্যেবেলায় ধর্মতলা মোড়ে চৌধুরী কেবিনে জমায়েত হতাম। সেখানে চায়ের সঙ্গে আড্ডা চলতো রাত প্রায় দশটা পর্যন্ত। এখানে তখন আসছেন গণেশ পাইন, বিকাশ ভট্টাচার্য, শ্যামল দত্ত রায়, ধর্মনারায়ণ দাশগুপ্ত , রবীন মণ্ডল, লালুপ্রসাদ সাহু সহ আরো অনেক শিল্পীরা। জ্যোতি সিনেমার উল্টোদিকে এক বাড়িতে ছিল সোসাইটি অফ কন্টেম্পরারির স্টুডিয়ো যেখানে নিয়মিত এঁরা আসতেন আর ওখান থেকে হেঁটে এই রেস্তোরাঁয়। আমি আর রতন নিয়মিত আসতাম, তবে রতন মাঝে মাঝে না এলেও আমি আসতাম। তখন দুজনেই ছাত্র, তাই বলে ওই আড্ডায় আমরা ব্রাত্য ছিলাম না, বরং বড়দের স্নেহ ও ভালোবাসা ছিল নিখাদ। ভারতীয় শিল্পের এই আখড়া আমার দৃষ্টিকে অনেক সুদূরপ্রসারী করতে সাহায্য করেছে। দিনের পর দিন সেখানে গেছি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে। রাত দশটায় চৌধুরী কেবিন বন্ধ হলে বিকাশ’দা ট্রামে চড়ে চলে যেতেন তাঁর উত্তর কলকাতার বাড়িতে, আমি আর গণেশ’দা হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি যেতাম। তখন অনেক কথা হতো যা আমায় গভীর থেকে গভীরে ভাবতে শিখিয়েছে। মাঝে মাঝে এমন হয়েছে রাত একটা বেজে গেছে, ইডেন হসপিটাল রোডের মোড়ের ওই ভ্যাটের পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলে চলেছি। হঠাৎ হাতের ঘড়ি দেখে দুজনেরই তখন ফেরার তাড়ায় অসমাপ্ত কথা তুলে রেখে গণেশ’দা চলে যেতেন কাছেই কবিরাজ রোডের বাড়ির দিকে আর আমি শ্রী গোপাল মল্লিক লেনের বাড়ির দিকে। অনেক সময় যখন বাড়ি ফিরে দেখতাম বাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেছে। কড়া নাড়লেও কেউ শুনবার মতো অবস্থায় থাকতো না। সারারাত বাইরে বসে কাটিয়ে দিতাম আর তখন মাথায় কত কথা ভেসে চলেছে আর পেটের ক্ষিদেয় কষ্ট পাচ্ছি। নিঝুম পাড়ায় কারো মাথাব্যথা ছিল না কে একাকী বাইরে বসে আছে না খেয়ে।

রতন একদিন বলে উঠলো ছুটিতে বোম্বে মামার বাড়িতে যাবে। আমি শুনে প্রথমে বললাম, ভালো তো তুই ওখানে কত শিল্পী আর তাদের কাজ দেখার সুযোগ পাবি। শুনেছি বোম্বেতে শিল্পের অনেক শিল্প-সমঝদার থাকেন, অনেক বড়ো বড়ো শিল্পীরাও থাকেন। আমরা যদি ওখানে বঙ্গের শিল্পীদের ছবি নিয়ে যাই, একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করি, তা হলে আমাদের শিল্পীদের গুরুত্বকে সবার সামনে তুলে ধরা যাবে। রতন এই আকাশকুসুম কল্পনাকে উড়িয়ে দিয়ে বললো, এটা তো একরকম অসম্ভব পরিকল্পনা। আমাদেরকে কেউ চেনে না, জানে না। আমাদের টাকা নেই। গ্যালারি বুকিং-এর ব্যয়, আমাদের ওখানে যাতায়াত ও থাকা-খাওয়ার খরচ এসব কে দেবে! আমিও ওর কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে পারিনি। তা ছাড়া এখানেইবা কে আমাদের বিশ্বাস করে ছবি দেবে? আমার মাথায় যখন এসেছে আমিও হাল ছাড়তে রাজি নই। সুযোগ পেলেই আমি দোতলা বাসের দোতলায় উঠে একদম সামনের সিটে বসতাম। তখন আমার মাথায় নানা পরিকল্পনা যেন কেউ বুনে বুনে দিয়ে যেত। একসময় ভূতগ্রস্তের মতো নেমে পড়তাম। ফাঁকা রাস্তায় কলকাতা দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যেতাম, আহা সুন্দরী তোমার তুলনা তুমি একমাত্র! পকেটে কানা কড়িও নেই অথচ আকাশকুসুম স্বপ্ন দেখার বিরাম নেই।

কলকাতার নকশাল আন্দোলন যেমন প্রতিদিন পাড়ায় ঢুকে টের পাই তেমনি আমার মাথাটাও যেন এদের মতো বিপ্লবী হয়ে উঠছে ক্রমশ। সেটাও বাসে উঠে টের পাই। আমার বহু বড়ো কাজের এটাই ছিল আতুড় ঘর।

আমি লেডি রাণু মুখার্জিকে একদিন সরাসরিই জানালাম আমার ভাবনা। তিনিও আকাশ থেকে পড়লেন। আমি বললাম, আপনার বোম্বেতে প্রচুর পরিচিত আছেন আপনি লিখে দিলে যাঁরা আমাদেরকে সাহায্য করতে রাজি থাকবেন। ওখানকার সব শিল্পী ও বিশিষ্টজন আপনাকে মান্য করেন। আমরা শৃণ্বন্তু থেকে এই অভিযান করতে চাই, কলকাতার সব শিল্পীদের কাছ থেকে ছবি নিয়ে প্রদর্শনী করবো বোম্বেতে। লেডি রাণু অবাক হচ্ছিলেন আমার অপরিণত ভাবনা শুনে। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়েই বললেন, তুমি পারবে এখনকার বড়ো শিল্পীদের ছবি নিয়ে যেতে? আমি বললাম, সেই কাজটা নিয়ে আমি ভাবছি না, ওটা আমার আয়ত্তে, আপনি শুধু বোম্বের ব্যবস্থাটা করে দিন। উনি বললেন, আমি তোমায় কিছু চিঠি লিখে দেবো। আশা করি উনারা তোমাদের জন্য কিছু করবেন। আমি তাতেই খুশি হয়ে চলে এলাম। জানি উনার চিঠির কী মূল্য। অর্থের যোগান নিয়েও দুর্ভাবনার অন্ত নেই। রেলে আমার এক পরিচিত দাদা ছিলেন। উনাকে রাজি করিয়েছি আমাদের জন্য কিছু কনসেশনের ব্যবস্থা করতে। তিনি বললেন যাওয়া-আসার একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। কিভাবে করবেন তা ভেঙে বলেন নি। আমাদেরও সে-নিয়ে মাথাব্যথা ছিল না। শিল্পীরা রাজি হলেন আমাদের এই অদ্ভুত অভিযানে তাদের মূল্যবান ছবি আমাদের হাতে তুলে দিতে। আজও আমি অবাক হই!

গণেশ পাইন সদ্য ইহুদী মেনুহিনের ভূয়সী প্রশংসা পেয়েছেন। মেনুহিন উনার ছবিও কিনেছেন। বিকাশ ভট্টাচার্য তখন সদ্য ললিত কলার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। এঁদের কাজ ছাড়াও সুনীল দাস, লালুপ্রসাদ সাহু, শ্যামল দত্ত রায়, রথীন মৈত্র, রবীন মণ্ডল, প্রকাশ কর্মকার, সুহাস রায়, ইন্দুভূষণ রক্ষিত সহ আরো অনেক শিল্পীর শিল্পকর্ম আর আমাদের নিজেদেরও কাজ ছিল। এখান থেকে ফোল্ডার ছেপে নিয়ে যাওয়া হবে, এতে আমাদের উদ্দেশ্য ও আবেদন সব থাকবে। কিন্তু কোথায় করবো আর কোথায় থাকবো কিছু ঠিক নেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে ঠিকই সবকিছুর ব্যবস্থা হয়ে যাবে। থাকার ব্যবস্থা হলো। গরমের ছুটিতে যাবার সব বন্দোবস্ত হয়ে গেলো। আমি ও রতন যাচ্ছি, সঙ্গে স্কেচ ক্লাবের কয়েকজন যাবে, তারা যে যার মতো থাকা ও খাবারের ব্যবস্থা করে নিতে সক্ষম। প্রায় এক মাসের জন্য যাওয়া হবে। কলকাতায় সবাই আমাদের কিছুটা হতাশ করেছিল এই বলে যে বোম্বের মতো জায়গায় আগে থেকে গ্যালারি বুক না করে যাওয়া বোকামি হবে। কথাটা তারা যে ভুল বলেছিলেন তা নয়, তবে এটা ছিল আমাদের একধরনের অভিযান, দেখা যাক না পারি কিনা। একটা বড়ো ট্রাংক কেনা হলো। সবার ছবি যত্ন করে প্যাক করে সেখানে ভরা হলো। বড়ো ছবি অন্যভাবে প্যাক করা হলো।

আমার পরিচিত রেলের সেই ভদ্রলোক যথাসময়ে আমাদের হাতে কনসেশনের টিকিট দিয়ে দিলেন। সেখানে এক বড়ো সমস্যা দেখা দিল, আমাদের সবার নাম পদবী বদলে গেছে! কিন্তু তখন আর হাতে সময় নেই। এই অবস্থায় আমরা অন্যের চেহারা শরীরে ধারণ করে ট্রেনে চেপে বসলাম, যদিও সবাইকেই এ-ব্যাপারে সচেতন করে দেওয়া হয়েছে। ট্রেনে দুদিনের যাত্রা। একাধিক চেকারের সন্দেহজনক দৃষ্টিকে পার করে চলেছি, কিন্তু মহারাষ্ট্রে ঢোকার পর প্রায় হাজতে ঢুকতে ঢুকতে বেঁচে গেলাম মূলত আমি আর রতন। বাকিদের কেউই সন্দেহ করে নি। আমাদের বয়স নিয়েই হয়েছিল সমস্যা। কোনোভাবে কী সব বুঝিয়ে হাত পা নাড়িয়ে বেঁচে গেলাম। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়লো। আমরা বোম্বে পৌঁছে গেলাম।

গণেশ পাইনের বাড়িতে আমি ও কবি শুভ রঞ্জন দাশগুপ্ত এক আড্ডায়

বোম্বেতে পৌঁছেছি। এই প্রথম এই বাণিজ্য নগরীতে পদার্পণ। এক বন্ধুর ব্যবস্থাপনায় আমরা দাদারে উঠেছি। সেই জায়গাটা থাকার জন্য ছিল না। ছিল বেশ কিছু জিনিসের গোডাউন। কোনোভাবে রাতটা কাটিয়ে পরের দিন থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে থাকতে শুরু করলাম। আমি আর রতন এখানে দিনকয়েক থাকার পর শেষে ওর মামার বাড়িতে থাকা শুরু করলাম। সেখান থেকে ট্রেনে করে শহরের মধ্যে যাতায়াত করতাম। লেডি রাণু আমাদের পরিচয় দিয়ে বেশ কিছু চিঠি লিখে দিয়েছেন। বিশিষ্ট শিল্পী কে কে হেব্বার, বেন্দ্রে, বোম্বে প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বোম্বে আর্ট সোসাইটির সভাপতি শিল্পী আরা ছাড়াও বেশ কযেকজনকে তিনি লিখে দিয়েছিলেন আমাদের সাহায্য করবার জন্য। এই বিশাল নগরীতে কয়েকজন অচেনা যুবককে কে আর পাত্তা দেন! সবাই লেডির চিঠি পড়ে সহযোগিতার কথা বলেন তবে কার্যক্ষেত্রে বিশেষ এগোয় না। আমরা হাল না ছেড়ে একের পর এক যোগাযোগকে এমন পর্যায়ে নিয়ে এলাম ততদিনে শহর আমাদের চিনে ফেলেছে। কিছু মিডিয়ার সাহায্যের ব্যবস্থা হলো। আমাদের কথা অনেকেই জানতে শুরু করেছে। ফ্রী প্রেস জার্নাল-এ আমার আর রতনের ইন্টারভিউ বেরোলো ছবিসহ।  আমার চেহারা এমনিতেই ঢ্যাঙা কালো কাকের মতো। সেই ছবিই ছাপা হয়েছে দুষ্মন্ত মুনির মতো অভিশাপরত। আমাদের চেহারাও পরিচিত হচ্ছে। দেখলাম এই রাস্তাতেই আমাদের এগোতে হবে। কলকাতা থেকে অহিদা অর্থাৎ অহীভূষণ মালিকও চিঠি লিখে দিয়েছিলেন আনন্দ বাজারদেশ পত্রিকার সাংবাদিক সলিল ঘোষের উদ্দেশে। সলিল বাবুকে বোম্বেতে সবাই বেশ সমীহ করেন। সলিল ঘোষ ছিলেন সাগরময় ঘোষের ভাই। তিনি আমাদেরকে প্রকৃতপক্ষে অনেক সাহায্য করলেন। আমরা গ্যালারি পেয়ে গেলাম, একেবারে জাহাঙ্গীর আর্ট গ্যালারির পাশেই Rampart Art Gallery। সদ্য শুরু হয়েছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গ্যালারি। তারাই আমাদের প্রদর্শনীর পুরো দায়িত্ব নিচ্ছেন। এ তো চাঁদ একদম হাতে এসে ধরা দিল! বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। এবার সবাইকে আমন্ত্রণ জানানো শুরু হলো। উদ্বোধন করবেন জে জে আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ। শিল্পী আরা সহ আরো অনেকে ছিলেন সেদিন হাজির। আমি হিন্দি ভালোভাবে বলতে শিখি নি, কিন্তু কাজ চালিয়ে গেছি। ওখানকার পুরি সবজি খেয়ে বেঁচে আছি। উদ্বোধনে আমি যে ভাষণ দিয়েছিলাম তা শুনে কেউ কেউ মুখ টিপে হেসেছিল। পরে কারণ জানলাম আমি হিন্দিতে সব লিঙ্গ গুলিয়ে দিয়েছি। রতন আগে থেকে ইংরেজি ভাষায় লিখে নিয়ে এসেছিল, তাই পড়েছিল। প্রদর্শনীতে ভালোই ভিড় হয়েছিল। পত্রিকায় অনেক আলোচনা বেরোয়। অনেকেই আমন্ত্রণ করে পার্টিতে যেতে বলছে, আমরা যাচ্ছি, আমাদের কথা বলছি, মানুষ আগ্রহ ভরে শুনছেন। এটাই আমরা চেয়েছিলাম। বিকাশ ভট্টাচার্যের একটা ছবি বিক্রিও হলো, আরও কয়েকজনের ছবিও বিক্রি হয়েছিল। আমাদের খরচের অনেকটাই সুরাহা হয়ে গেলো। কিন্তু অবাক হলাম গণেশ পাইনের একটা চমৎকার ড্রইং ছিল বাঁদরের সেটা বিক্রি না হওয়াতে। একদিন হুসেন সাহেব এলেন, কিছুক্ষণ কাটিয়ে গেলেন।

একদিন শিল্পী হেব্বারের বাড়িতে যাবার জন্য অনুরোধ আসে। আমরা দুজনে যাই রাস্তা খুঁজে খুঁজে, তখনতো আর গুগল ম্যাপ ছিল না। যাবার পথে আমার ততদিনে দুর্বল হয়ে পড়া স্যান্ডেলটা গেলো ছিঁড়ে। আমি কাছাকাছি কাউকে পাই নি যিনি উদ্ধার করবেন। বা নতুন চটি কেনবার মতো অবস্থাও ছিল না। আর চটির দোষ আর দেই কী করে, বিগত কিছু দিন এই চটির উপর দিয়ে কম ধকল যায় নি। আমি ওই চটি কাগজে মুড়ে একদম খালি পায়ে শিল্পীর প্রাসাদোপম বাড়িতে হাজির হলাম।  নিচে জুতো ছাড়ার জায়গায় রতন জুতো ছেড়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে লাগলো আর আমি ওর পেছনে পেছনে ওই কাগজে মোড়া চটি খুব যত্নে হাতে করে এনে হেব্বার সাহেবের চায়ের টেবিলে রাখলাম, যেনো কোনো অমূল্য বস্তু সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি। হেব্বার সাহেব শিল্পী হিসেবে আন্তর্জাতিক মর্যাদাসম্পন্ন একজন। তাঁর সামনে আমরা বেশ অবলীলাক্রমে কলকাতার শিল্প নিয়ে আলোচনা চালিয়ে গেছি। তিনি লেডির খোঁজখবর নিলেন। ফিরে এলাম ওই জুতোর সুন্দর প্যাকেট হাতে নিয়ে, মনে মনে মাপ চেয়ে নিয়েছিলাম এই মহান শিল্পীর কাছ থেকে। এখানে এসে আরও বুঝলাম সারা ভারতে লেডি রাণু ও অ্যাকাডেমির কী মর্যাদা। শিল্পী বেন্দ্রের কাছে গিয়েও তাই বুঝলাম। উনার একটি চোখ পাথরের, বড়ো স্টুডিয়োতে বড়ো বড়ো ছবি এঁকে চলেছেন। এখানে শিল্পীদের জন্য একটা আলাদা জায়গা করে দেওয়া হযেছে যেখানে শিল্পীরা নিশ্চিন্ত মনে কাজ করতে পারবেন। এটা সরকারই করে দিয়েছে। একদিন শিল্পী আরার কাছে নিজে থেকেই দেখা করতে গেলাম। আমরা অবাক হলাম, তিনি তো আমার ঘরের চাইতেও ছোট একটা ঘরে থাকেন। ছোট এক বিছানা কাম বসার জায়গায় তিনি নিদ্রা যান। এত বড়ো মাপের একজন শিল্পীর জীবনযাত্রা সেদিন আমাদের নাড়িয়ে দেয়। আমরা ততদিনে জেনে গেছি তিনি কোন উচ্চতার শিল্পী ছিলেন, যার ছবি নিলামে কোটি টাকার বেশি দামে বিক্রি হয়। তিনি, মকবুল ফিদা হুসেন, রাজা, তায়েব মেহেতা এনারা সবাই বাংলার পরেই ভারতীয় শিল্পকে আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যেতে পেরেছেন। তবে আমরা বোম্বের শিল্পীদের মধ্যে অন্য একটি দোষও দেখেছি, ওরা আমাদের খুব ঈর্ষা করতো। কোনোভাবেই চাইতো না বাংলার শিল্পীরা ভারতবর্ষে বেশি গুরুত্ব পাক। তবে হুসেন সাহেব ছিলেন আবার ভিন্ন, তিনি সত্যিটা বুঝেছিলেন, এবং সেটা কবুল করতে দ্বিধা করেন নি।

ইলাস্ট্রেটেড উইকলির হয়ে তিনি ভারতের দশ জন শিল্পীর নাম একবার ঘোষণা করেছিলেন, তাতে গণেশ পাইন ছিলেন এক নম্বরে। তা ছাড়া সেই চল্লিশ দশকের সময় থেকে বোম্বের এই প্রগ্রেসিভ আর্টিস্ট গ্রুপের সঙ্গে আমাদের এখানে গড়ে ওঠা ক্যালকাটা গ্রুপ যাতে রথীন মৈত্র, গোপাল ঘোষ, নীরদ মজুমদার, গোবর্দ্ধন আশ, জয়নুল আবেদীন, পরিতোষ সেন, সুনীলমাধব সেন, প্রদোশ দাশগুপ্ত সহ আরো অনেকেই ছিলেন, যারা ভারতের আধুনিক শিল্পের এক নতুন ধারা গড়ে নিজেদের সামনে আনলেন, এটা বোম্বে গোষ্ঠী মানতে চাইতো না। এই বিবাদ শিল্পের সামগ্রিক পরিবেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। তবে ইতিহাসকে বদল করার চেষ্টা হলেও তা ক্ষণস্থায়ী হয়েছিল। আজও বাংলার শিল্পীদের অনেক অকারণে ভুগতে হয় বা আন্ডার এস্টিমেশন করে রাখার সেই চেষ্টাটা একইভাবে চলছে।

প্রদর্শনী শেষ হওয়ার পর বহু বিদগ্ধ মানুষের সঙ্গে আমাদের নানা আমন্ত্রণ রাখতে হয়েছিল। নেমন্তন্ন শেষে রাতের ফাঁকা ট্রেনে করে হওয়া খেতে খেতে ফিরতাম।

এবার ফেরার পালা। সেই আসার পাসে আমরা ফিরছি, আর ভাগ্যের কী পরিহাস সেই ট্রেনে সেই একই টিকিট চেকার উঠেছে যার হাত থেকে কোনোক্রমে মুক্তি পেয়েছিলাম আসার সময়। এবার বাধ্য হয়ে চললো লুকোচুরি। এতো কষ্ট করে বোম্বে জয় করে এসে শেষে হাজত বাস করতে হবে! এ-তো বাংলার ইজ্জতের প্রশ্ন। আমরা দুজনেই তৎক্ষণাৎ বমি করতে শুরু করলাম আর বাথরুমেও যাচ্ছি আর আসছি। সেই চেকার কিছুক্ষণ থেকে ধীরে ধীরে আমাদের মুক্তি দিয়ে বিদায় নিলেন। সারারাত দুজনেই খুব অসুস্থতার ভান করে কাটিয়ে দিলাম।

আমাদের সেই যাত্রা সফল হয়েছিল। কলকাতায় যারা ভেবেছিলেন আমরা বৃথাই যাচ্ছি, তাদের ভাবনার বদল ঘটলো। সব শিল্পীদের কাছেই আমরা সমাদৃত হলাম। কেবল হলাম না কলেজে। সেখানে আগে থেকেই রটে গিয়েছিল অনেক কাল্পনিক কথাবার্তা যা চিন্তামনি করকে উত্তেজিত করেই রেখেছিল, পরবর্তী সময়ে প্রতিপদে তিনি এর প্রতিফলন দেখাতে দেরি করেননি। কলেজের এই দুই ছোকরা কলকাতার তাবদ শিল্পীদের নিয়ে কিনা বম্বেতে প্রদর্শনী করে এলো! যেনো কলেজের মান আমরাই খুইয়ে এলাম আরকি!

আমি লেডির সঙ্গে দেখা করে সব জানালাম, উনার একটা অভ্যেস ছিল খুব খুশি হলে সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্টিন থেকে সিঙ্গারা আর দরবেশ এনে খাওয়াতেন। সেদিনও তাই হলো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সব জানলেন, উনার সেই অসাধারণ চোখ দেখলাম আমার জন্য গর্বিত। শুধু বললেন একদিন অ্যাকাডেমিতে আলোচনা সভা ডাকা হবে সেখানে তোমাদের এই অভিযানের কথা বলবে। আমি বলে দিচ্ছি তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করতে।

বোম্বে প্রদর্শনীর কিছু ছবি যেখানে শিল্পী আরা সহ ভারতের অনেক বিখ্যাত শিল্পীদের উপস্থিতি

কলকাতার মধ্যেই অন্য কলকাতা, তারাশঙ্কর থেকে বেচারাম ঘোষ

বোম্বে থেকে লোটা কম্বল নিয়ে আবার নিজের খাঁচায় ফিরে আসি। আমার পাড়া মানে কলেজ স্ট্রিট পাড়া, এখন আরও থমথমে পরিবেশ হয়েছে। মুক্তির দশক আসতে আর এক বছর কি দুবছর। বোম্বে গিয়ে সম্মুখীন হয়েছিলাম অনেক কৌতূহলের। আমাদের বহুবার এক প্রশ্নের সন্মুখীন হতে হয়েছে, লেক এ-তে অনুষ্ঠিত হওয়া সম্ভবত অশোককুমার নাইটে যে বিপুল হাঙ্গামা হয়েছিল সেখান থেকে নাকি লরি-লরি ভর্তি জুতো, মেয়েদের জামাকাপড়, লাশ পাওয়া গেছে? আমরা তাজ্জব হতাম ওদের এইসব বিশ্বাস শুনে। কলকাতায় নকশালরা ধ’রে ধ’রে মাথা কাটছে? এসব প্রশ্নেরও উত্তর দিতে হতো। এই ছিল কলকাতার বাইরে আর এক কলকাতা। আমার কলেজ স্ট্রিটের পাড়ায় অনেক পরিচিতরাই কেমন যেনো অপরিচিত হতে শুরু করেছে। আমাদের মতো তরুণদের সবদিক থেকে ছিল সমস্যা। পুলিশ আমাদের সন্দেহের চোখে দেখে, বড়রাও সন্দেহের চোখে দেখে। তবে আমার বন্ধুরা বা অনুজরা যথেষ্ট আমায় ভালোবাসে।

আমি দেখি আমাদের পাশের পাড়া গোবিন্দ সেন লেনের সেই গোবিন্দ বাবুদের বিরাট রথের জৌলুস আর নেই, ওই বাড়িতে আগে উঠোনে যাত্রার আসর বসত এখন বসছে না, পাড়ায় মল্লিকদের তিনটে বিরাট বাড়িতে রাজকীয় দুর্গাপূজা হতো তারও জৌলুস যেনো কমে এসেছে! এসব নাকি বুর্জোয়াদের অতিরিক্ত খরচ।

আমি কি করে ওদের মধ্যে একসময় পৌঁছেও গেলাম, চাক্ষুষ করলাম কীভাবে ওরা অ্যাকশন করে আর আমাদের মতো তরুণদের পরিচালিত করে, রামকান্ত মিস্ত্রি লেনে এক পোড়ো বাড়িতে হতো ওদের জমায়েত। আমি কয়েকবার গেছি। আমাকে বিশ্বাস করে আমার সামনেই চলতো ওদের আগামী পরিকল্পনা, যা আমি নির্লিপ্তভাবেই শুনতাম। এসব চিন্তা করে অনেক সময় আমার রাতে ঘুম হত না। তখন এমনিতেই পাড়া রাত জাগতো, পুলিশ রাতেই হানা দিতো, আমার এই ঘরও বাদ যায়নি কপালজোরে আমার সামনে রাখা বইয়ের টেবিলে রেড বুক যা তখন নিষিদ্ধ ছিল রাখা, ওরা ঢোকার আগেই অন্য বইয়ের অনেক নিচে চালান করে দিতে পেরেছিলাম।

আমার কাছে অনেকে এসেছে, পোস্টার লেখার জন্যে, করেও দিয়েছিলাম। কিন্তু আমার কৌতূহল এইসব ছেলেদের নিয়ে ছিল। অনেকের সঙ্গেই আমার সখ্যতা গড়ে উঠেছিল, যাদের পরবর্তী সময়ে পুলিশের গুলিতে মরতেও দেখেছি, এরা কি অবলীলায় হত্যা করতো। আর অল্প বয়েসী ছেলেগুলো অ্যাকশনের সময় এত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারে সে-আমার কল্পনার বাইরে ছিল। এই নিয়ে গণেশ পাইনের সঙ্গে অনেক কথা হতো, তিনি আরও খুঁটিয়ে জানতে চাইতেন এইসব অন্ধকারের মুখগুলো সম্পর্কে। ওর ছবিতেও এর প্রভাব পড়েছিল। আমার অভিজ্ঞতা ক্রমে বাড়তে থাকে, আর মন খারাপ হয় যখন পাড়ার ঐতিহ্যকে ক্রমে নষ্ট হতে দেখি। আমি আমার ছবি আঁকা লেখা আমাদের ‘শৃণ্বন্তু’ নিয়ে ব্যস্ত থাকি, জানি না আমার মধ্যে কোনো দ্বৈতসত্তা কাজ করছে কিনা, আমাদের এক চ্যারিটি শো হবে শৃণ্বন্তুর লাইব্রেরি গড়ার জন্য, লোটাস সিনেমা হলে হবে ‘নিশীতে’ সিনেমাটি। প্রধান অতিথির জন্য তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের কাছে অনুরোধ নিয়ে যাওয়া হবে, আমি উনার ঠিকানা ইত্যাদি জোগাড় করলাম। গণদেবতার স্রষ্টার কাছে যাবার অন্য এক রোমাঞ্চ ভেতরে-ভেতরে কাজ করছে। আমার সঙ্গে কলেজের এক বান্ধবীও সেদিন গিয়েছিল উনার টালার বাড়িতে। বাড়ির বারান্দায় স্তূপ করে রাখা আছে অনেক গাছের শেকর-বাকর, বাড়িতে ঢুকতে বাঁ দিকে রাখা আছে যা চোখে পড়বেই। নিচের ঘরেই তিনি ছিলেন। রোগা চেহারা, তামাটে গায়ের রং, একটা সাদা ফতুয়া, চোখে সোনালি ফ্রেমের চশমা, মেঝেতে জলচৌকির মতো লেখার টেবিল। আমরা আর্ট কলেজে পড়ি শুনে তিনি খুব আগ্রহভরে ঘরে বসালেন। আগেই আশুতোষ ভট্টাচার্য বলে রেখেছিলেন আমাদের কথা। ঘরের দেওয়ালে ঝোলানো রয়েছে উনার আঁকা কিছু ছবি যা দেখে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবির কথা মনে আসে। আমাদের দেখিয়ে বললেন, আমার আঁকা, কেমন হোয়েছে তোমরা ভালো বলতে পারবে। আমরা অন্য মন্তব্যের সাহস দেখাবার চেষ্টাই করিনি। বলি খুব ভালো লাগছে, এখন কি আপনি নিয়মিত ছবি আঁকছেন? ওই মাঝেমাঝে শখে করি, এখন গাছের শিকড়-বাকর নিয়ে অনেক কিছু বানাচ্ছি। বসো দেখাই, বলে বারান্দা থেকে কিছু সেরকম শিকড় আনলেন যা তিনি কিছুটা কেটে একরকম মানুষের আকৃতি গড়েছেন, ঠিক যেমনভাবে একসময় অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুটুম কাটাম করেছিলেন। আমাদের ভালই লাগলো, বলতে দ্বিধা ছিল না। এরপর আমাদের আগমনের উদ্দেশ্য জানলেন এবং কথা দিলেন আসবেন। আমরা খুশি হয়ে ফিরে আসি। কার্ড ছাপার পর আবার উনার কাছে আমন্ত্রণলিপি পৌঁছতে যাই, সেদিন উনার ছেলে এসে জানালেন বাবার শরীর খারাপ হয়েছে, কার্ডটি তিনি রেখে দিলেন, বললেন শরীর ভালো থাকলে তিনি আসবেন।

শরীর আর ভালো হয়নি, অনুষ্ঠানের আগের দিন আমার বাড়ির ঠিকানায় উনার হাতের লেখা চিঠি এসেছে যেখানে তিনি অনুপস্থিত থাকার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। চিঠিটি অনেকটাই লিখেছিলেন যা আমি অনুষ্ঠানে পাঠ করি। মুক্তোর মতো ছিল সেই হাতের লেখা। সেদিন হলে উপস্থিত ছিলেন অনেক মান্যগণ্য ব্যক্তিরা, এমন অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছিলাম যা আমার জীবনে উজ্জ্বল স্মৃতি হিসেবে চিহ্নিত থাকবে। আজও ভুলবো না তারাশঙ্কর বন্দোপাধ্যায়ের মতো এত বড়ো মাপের একজন মানুষ তাঁর নতুন সৃষ্টিকে আমাদের মতো নবীনের কাছ থেকে মূল্যায়ন চেয়ে কতটা ব্যাকুল হয়েছিলেন।

আমাদের সাইক্লোস্টাইল প্রমিতি দেখে বাজার থেকে কিনে একদিন সকালে আমার সেই স্বর্গতুল্য ঘরে হাজির হলেন এক ব্যক্তি। কোনো ভনিতা না করে বললেন আপনাদের এই পত্রিকাটি আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, তাই ঠিকানা খুঁজে চলে এলাম। উনার বয়েস মধ্য পঞ্চাশের কাছাকাছি, নামটাও কেমন বেচারাম ঘোষ, পরিচয় দিলেন তিনি কলকাতা করপোরেশনের ঠিকাদার, শ্রমিক চড়িয়ে রোজগার। আমি একটু ঘাবড়েই গেলাম। তিনি বললেন দেখুন এখন দিনকাল খারাপ যাচ্ছে। পাড়ায় অপরিচিত লোক দেখলেই তাকে সন্দেহ করা হয় পুলিশের লোক ভেবে, আর আপনাদের এই এলাকাটি বেশ রহস্যে মোড়া,  আসার পথে অনেকেই কেমন চোখে দেখছিলেন। আমি তো নম্বর খুঁজে ঠিক চলে এসেছি। আমি থাকি তালতলায়। একটা অনুরোধ নিয়ে এসেছি। আমি এইসব ঠিকাদারদের সংগঠনে আছি, একটা বুলেটিন জাতীয় কিছু বার করতে চলেছি। প্রতি মাসেই বেরোবে, আপনি একটা করে কভার করে দেবেন এই সাইক্লোস্টাইল কাগজে। আপনাকে এর জন্য এত টাকা দিতে পারবো, আশা করি আমায় ফেরাবেন না। আমি তখন কাজের জন্য হা পিত্যেশ হয়ে ঘুরছি, ছবি আঁকতে অনেক খরচ, কীভাবে যে দিন যাচ্ছে একমাত্র আমি তা জানি। আমি কিছুমাত্র ভনিতা না করে বললাম, না করার কি আছে, আপনি আমাদের পত্রিকা পড়ছেন ভালো লাগছে, এটাই তো আমাদের কাছে অনেক। আপনারা ব্যবসায়ী মানুষ, আমাদের শিল্পকে ভালোবাসছেন এটাই যথেষ্ট। আপনি আমাকে দিয়ে যাবেন করে দেবো।

এই মানুষটা যত দিন গেছে আমার কাছে অপরিহার্য হয়ে উঠছিলেন। যত গভীরে যাচ্ছি দেখছি উনি অনেক পণ্ডিতের চেয়ে পণ্ডিত, আমি তার কাছে নেহাতই এক শিশু। কিন্তু উনি কোনোদিনই নিজেকে জাহির করতে আগ্রহী ছিলেন না। আমি আমার অনেক লেখায় উনাকে বিশেষ সন্মানের আসনে বসিয়ে নিজে তৃপ্তি পেতাম। উনার সম্পর্কে সামান্য কিছু পরিচয় দিয়ে রাখি কেননা আমার চলার পথে বারেবারেই উনি আবির্ভূত হবেন। উনারা কয়েক ভাই তালতলায় ডক্টরস লেনের এক মেসে থাকেন পুরো বাড়িটা নিয়েই। যেখানে কোনো খাট নেই, সবাই মাটিতে বিছানা পেতে শোয়। গ্রামের বাড়িতে সপ্তাহান্তে যান। গ্রাম হলো পাতিহালে, ডমজুরের কাছে। সবাই ঠিকেদারির কাজে যুক্ত, দেশের বাড়িতেও সবাই পরিবারসহ একসঙ্গে থাকেন, সেখানে সুন্দর সাজানো গোছানো তিনতলা বাড়ি, ঝকঝকে পালঙ্কে ঘুমানোর অভ্যেস। আমি সুন্দরম-এর সব সংখ্যা উনার কাছে প্রথম দেখি। উনার কাছে যত্নে রাখা আছে ভারতবর্ষ, প্রবাসীর অনেক সংখ্যা। পুরনো রেকর্ডের সংখ্যাও প্রচুর যা তিনি নিয়মিত শুনতেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে