ল্যান্ড-গার্ড: ছবির সাথে একান্ত বোঝাপড়া

0
111

একটা ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে এই ছবির লেখাটা শুরু করি; ল্যান্ডস্কেপ বলতে আমরা বাংলায় নিসর্গচিত্র বলে জানি; যতদূর চোখ যায় ততদূর আমার জমিন ও আসমান যেন। কখনও এই সুদূরের কল্পনা আমাদের আত্মার চাহিদাকেও তৃপ্ত করে। আমাদের সকলের মনের মধ্যেই প্রায় মালিকানার স্বত্ব লুকিয়ে-চুরিয়ে থাকে। সেই মালিকানার স্বাদ কখনো-সখনো আমরা শিল্পী ও দর্শক উভয়েই ছবির মধ্যেও খুঁজে ফিরি। গত কয়েক বছর চিত্রশিল্পী অনুপম রায় এই ল্যান্ডস্কেপের দেখার ধরনটা (ডমিন্যান্ট ডিসকোর্সের বাইরে গিয়ে)  আমাদেরকে অন্যরকমভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছে।

আমি গল্প করবো তাঁর নয় বাই নয় ফিট, ছয় বাই নয় ফিটের ত্রিপলের ক্যানভাসে আঁকা সাদা-কালো ছবির মাধ্যমের পাঁচটি ল্যান্ডস্কেপ ড্রয়িং নিয়ে। এই সমকালীন পাঁচটি বড় ল্যান্ডস্কেপের কাজ যেখানে তাঁর নিজের অঞ্চল, সময়, আর রাজনীতি মিলেমিশে এক হয়ে এমন একটি ছবির ভাষা নির্মাণ করেছে যেখানে এই ল্যান্ডস্কেপকে বাংলায় অনুবাদ করলে তার অর্থ আর শুধুই নিসর্গচিত্র থাকছে না।

গত ২০২৩ এর মে মাস নাগাদ অনুপমের ছয় বাই নয় ফিটের বিশাল ছবিটির সামনে যখন দাঁড়াই, দেখি তার উত্তর চব্বিশ পরগণার মাঠ-জমিনের নিসর্গচিত্রের সামনে একটি প্রকাণ্ড শরীরের মোষ দাঁড়িয়ে, যেন মোষটি দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে এক অবোধ্য দৃষ্টি নিয়ে। আর একই সাথে প্রবল আক্রোশে চিবিয়ে খাচ্ছে ঘাস মারা বিষ, তেলের বোতল রাউন্ড আপ। পাশেই রাখা বহুজাতিক ইফকো কোম্পানির রাসায়নিক সারের শেষ হয়ে যাওয়া বস্তা।  মোষটির পিছনে অনুপম তার অঞ্চলের মাঠ-জমিন-আসমানের ছবি এঁকেছে যা দর্শককে দূরে নিয়ে যাবে ক্ষণিকের জন্য। সেই ক্ষণিকের মধ্যে দর্শক দেখতে পাবে মাঠ শেষের নয়ানজুলির জলাভূমির উপর গড়ে উঠা কংক্রিটের দালান; যার দেওয়ালে আছে ইমামির ডবল বুল সিমেন্টের বিজ্ঞাপন ; যে বিজ্ঞাপনের দুটি ষাঁড়ের ছবি আমাদের গ্রাম বাংলায় এখন আনাচে-কানাচে। আরেকটু দূরে দর্শক হেঁটে গিয়ে পথের ধার ঘেঁষে দেখবেন পরপর তিনটি ফোনের টাওয়ার। এছাড়া এই ছবিতে আছে তাঁর জলাভূমির দেশের কচু গাছ, কচুরিপানা, ইত্যাদি। এই ছবিটির মজা হল দর্শক ছবিটিতে দূরে গিয়ে জমিন আসমানের আরাম/ পরিতোষ / চিত্তপ্রসাদ / বাসনা তৃপ্ত করতে পারবে না। একটি আক্রোশী মোষ তার চোখ দিয়ে দর্শককে টেনে নেবে বারবার।  

প্রথম দর্শনে এই ছবিটি দেখেই মনে পড়বে জয়নুল আবেদিনের বিখ্যাত সেই ছবি REBEL COW/ 1951[58.5/76 cm] এর কথা। গরুটি দড়ি ছিঁড়ে অনির্দিষ্ট আগামীর দিকে ধাবিত। তবে রেবেল কাও এর সেই মুহূর্তটিতে গরুটি ছিল মাথা গুঁজে, অজানা সম্মুখের শত্রুকে গুঁতোনোর ভঙ্গিমাতে। অনুপমের এই ছবিতে ৭২ বছর পর সেই গরুটির গতি যেন এই মোষটি ধারণ করে ; তার সময়কে শরীরে ধারণ করে; দর্শকের দিকে প্রবল আক্রোশে তাকিয়ে। এই ছবির মোষটি এখন যেন দীর্ঘ এই সময় অতিক্রম করে জেনে গেছে তার দর্শকের অন্তরমন, আগ্রাসনকেও। তাই এই সাদা কালো ছবির মধ্যেও আমি দর্শক হিসেবে মোষটির রক্তচক্ষু দেখতে পাই যেন। আর ছবিটি জুড়ে এই মোষটি তার নিজের শরীরে বহন করে জমিন আসমানের দিগন্ত বিস্তৃত ল্যান্ডস্কেপকে। আমি দর্শক হিসাবে চাইলেও বিচ্ছিন্ন করতে পারি না মোষটিকে তার ল্যান্ডস্কেপের সাথে। আর এই পরিচিত ল্যান্ডস্কেপ আর মোষটির প্রবল হিংস্রতায় রাউন্ড আপ ঘাস মারার বিষের বোতল চিবিয়ে খাওয়ার দৃশ্য আমাকে নিয়ে যায় ঘাস মারার বিষ ব্যাবহারের ইতিহাসে; ইফকো, মনসান্ট কোম্পানির আধিপত্যে চাষ জমির বিবর্তনের কথাতে। শৈশবে আমাদের মাঠে ঘাস নিড়ানো ক্ষেত মজুরের স্মৃতিতে। এক বিঘা জমিতে আগে দশটি কৃষি মজুরের কাজ এই বহুজাতিক কোম্পানির ঘাস মারা রাউন্ড আপ সেই কর্মক্ষেত্র খেয়ে নিলো। আর জমির কাজ সংকুচিত হতে হতে গ্রামের মানুষই বাইরে কাজ খুঁজতে বেরল। গ্রাম বিরান হতে শুরু করলো। মজুরের সাথেই যেন জমির আলে কুচো মাছ, লাঙলের ফালে সাদা বক পরদেশী হলো। আর মোষটির ফাঁস আরও ছোট হলো; রাউন্ড আপের জমিতে ঘাস জমিতে বিচরণ নিষিদ্ধ। মোষটি আসলে আমাদের এই সময়ে ক্ষেত জমির জন্য, ক্ষেত মজুরের জন্য, কুচো মাছের জন্য, সাদা বকের জন্য আরও আরও কত কিছুর জন্য যেন জানকবুল এক শেষ লড়াইয়ের কথা জানিয়ে দিল মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও।

অনুপমের সাথে কথাসূত্রে জানতে চাই, এখানে সে মোষটিকে কীভাবে দেখে। সে উত্তরে বলে এদেশে মোষ যেমন বড় অংশের কৃষি কাজে ভারবাহক, এছাড়াও মোষের উপর ধর্মীয় সামাজিক এক ধরণের নিষ্পেষণমূলক দেখা ইতিহাসকে সে বহন করে। মোষ তার ছবিতে তাই সেই ল্যান্ডগার্ডের আরেকজন উপস্থাপক হয়ে ওঠে। যে প্রাণীটি তার অবস্থান আর ইতিহাস নিয়ে এই সময়কে তার শরীরে ধারণ করে।

ল্যান্ড-গার্ড ৪; ৬/৯ ফিট, ত্রিপল

মৃত্যুর কথা এলে এই পাঁচটি ছবির আরেকটি ল্যান্ডস্কেপের কথা মাথায় আসে; আসামের চরের মইনুল হক আর গাঙ শালিকের ছবিটির কথা। ১৯২৬ সালে এই চরের ল্যান্ডস্কেপ নিয়ে বন্দে আলী মিয়া লিখেছিলেন

“বরষার জল সরিয়া গিয়াছে জাগিয়া উঠেছে চর;
গাঙ-শালিকরা গর্ত খুঁড়িয়া বাঁধিতেছে সবে ঘর।”

এই কাব্যগ্রন্থে কবি চরের ল্যান্ডস্কেপকে শব্দ দিয়ে এঁকেছেন। অনুপমের এই ছবিটি প্রভাবিত হয়েছে এই কবিতা দ্বারা, মূলত এই লাইন দুটি থেকে। এই ছবির ল্যান্ডস্কেপের সাথে যেমন জুড়ে গেছে আমাদের শৈশব পাঠ্যের কবি বন্দে আলী মিয়ার এই টেক্সটি; এই চরের ল্যান্ডস্কেপ আঁকতে গিয়ে তেমনি অনুপমের ছবিতে উঠে আসে তাঁর সমসাময়িকতা। তাঁর এই ছবিতে চরের জমিনে যতটা গাঙ-শালিকের বাসা গুরুত্বপূর্ণ ততটাই মইনুল হকের বাসা। এই গাঙ-শালিকের বাসা বাঁধার প্রাকৃতিক নিয়মের সাথে জুড়ে যায় মইনুল হকের কথা। লুইত পারের মইনুল হক; যার মৃত শরীরের উপর রাষ্ট্রের পক্ষে থাকা ফটোগ্রাফারের ঘৃণার দৃশ্য আমরা সকলেই দেখেছি। আমরা দেখেছি একা বুক টান টান করে লাঠি হাতে অসংখ্য বন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মইনুল হককেও। তখন মইনুল হক একা হলেও একা নয়, ইতিহাসের পাতা থেকে নুরুলুদ্দিন সমেত অসংখ্য কৃষকের প্রেত তার সাথে এক হয়ে এই ইতিহাস লিখে যায় মুহূর্ত দিয়ে। চরের মানুষের যাপন-জীবন-জীবিকায় এবং দ্বন্দ্বে অনিবার্য বাসা বাঁধা , বাসা ভাঙা। চরের মানুষেরা নদীর মর্জি মেনে নিতে জানে। প্রকৃতির ভাঙা গড়ার এই অনিশ্চয়তাকে সাথে নিয়ে গাঙ-শালিকের মতোই বাঁচতে জানে, নতুন বাসা বাঁধতে জানে। কিন্তু নদীর মর্জি মেনে নেওয়া আর রাষ্ট্রের মর্জি মেনে নেওয়ার মধ্যে ফারাক করতে জানে মইনুল নুরুলুদ্দিনরা । রাষ্ট্র যখন বুলডোজার এনে বাসা গুঁড়িয়ে দেয়, বলে দেয় কে নাগরিক আর কে নয়। সমস্ত অধিকার যখন জবরদস্তকারীর বেয়নটের সামনে তখন ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হয়, রংপুরের কৃষক আন্দোলনের (১৭৮৩) নুরুলুদ্দিনের মতো মইনুল হক তার লাঠি নিয়ে এগিয়ে আসে। নুরুলুদ্দিন বা মইনুল হকেদের খুন করে ঘৃণার সাথে মৃত শরীরের সাথে হিংসা করতে পারে রাষ্ট্র আর তার পক্ষের লোকেরা। কিন্তু রাষ্ট্র আর তার পক্ষের লোকেরা জানে না, নদীর মর্জির কথা। তার আশ্রয়ের গাঙ-শালিকেরা আর চরের মানুষেরা জানে, নদী আবার নতুন জমিন তৈরি করবে, গাঙ-শালিকেরা আর চরের মানুষেরা আবার নয়া জমিনে গর্ত খুঁড়ে বাসা বাঁধবে, আবার নুরুলুদ্দিন আর মইনুল হকের লাঠি আসমানি মেঘের গর্জন নিয়ে হাঁক দেবে “জাগো বাহে কোনঠে সবাই” (সৈয়দ শামসুল হক)।

এই ছবিটিতে আরেকটি বিষয় দর্শক হিসেবে মনে হয়; গাঙ শালিকের গর্ত খোঁড়ার দৃশ্য যেমন ল্যান্ডস্কেপের জমিন-আসমানকে এক করে রেখেছে; তাকে পেরিয়ে চরের ভিতরে ঢুকতে গিয়ে বাম পাশে বিস্তৃত জমির আল ধরে মইনুল হকের লাঠি তুলে প্রতিরোধের দৃশ্যটি সমানভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। তবে তা খুব সচেতনভাবেই শিল্পী দূরে অনেক দূরের দৃশ্য হিসাবে এঁকেছে। কারণ সত্যই আমাদের এই দেশে পরিচিতির কারণে শিল্পী আর দর্শক থেকে মইনুল হকের উপর নেমে আসা হিংস্রতার ঘটনাটি অনেকখানি দূরের। স্পর্শ করতে না পারার মতো দূরত্ব। ডান দিকের সেই ল্যান্ডস্কেপের খুব ছোট অংশকে দখল করে রয়েছে বুলডোজার সশস্ত্র বাহিনী, বাহিনীর সেই ফটোগ্রাফারটি, যে কিছু মুহূর্ত পরেই গুলিবিদ্ধ মইনুল হকের মৃত শরীরের উপর বারবার লাফাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রংপুর বিদ্রোহ, নুরুলুদ্দিন থেকে মইনুল হকের মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও তাঁদের প্রবল প্রতিরোধের ছবি গাঙ শালিকের বাসা বাঁধার মতোই শাশ্বত হয়ে ওঠে।

ল্যান্ড-গার্ড ৩; ৯/৯ ফিট; ত্রিপল

এর পরের ল্যান্ডস্কেপে চিত্রশিল্পী অনুপম তাঁরই অঞ্চলের শ্যালো মেশিনের ছবি আঁকে। ক্ষেত জমির আল বরাবর একটি ডিজেলের শ্যালো মেশিন ; মোটরটি চুরি হয়ে যাওয়া আটকাতে মোটরটি টিনের ড্রাম দিয়ে ঢাকা। ঠিক তার পাশেই একটি পা পড়ে আছে; দর্শক হিসেবে মনে হল একটি মৃত মানুষের পা; পায়ের পাশেই একটি বিল। বিলটি কিসের; রাসায়নিক সার, নাকি ব্যাংক লোনের, সুদের, নাকি মহাজনের কাছে ধার করা টাকার সুদের রসিদ। এই পায়ের মালিক কে ? সে কি কৃষক ? সে কি মৃত ? তার জমিনে পড়ে থাকা শরীরে আসমান মিশে যায় কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর হাতড়াতে হাতড়াতে; আমার স্মৃতি আমাকে এই ছবির দর্শক থেকে আরও একটু এগিয়ে নিয়ে যায়; ঠিক এমনই একটা শ্যালো মেশিনের পাশে কৈশোরে একটা লাশ দেখেছিলাম। আমাদের গ্রামের স্কুল পাড়ার দোয়াত আলী দাদার ছেলে লুতফার কাকার লাশ। জলের অভাবে বিবর্ণ ধান ক্ষেতে শ্যালো মেশিনের পাশে পড়ে থাকা লাশ। তখন শুনি লুতফার কাকা বিষ খেয়েছে; তবে গ্রামে দুটো পক্ষের দুই বক্তব্য ছিল। এক অংশ বলেছিল ঘরে অশান্তির কারণে সে বিষ খেয়েছে।  চাষি পক্ষের বড় অংশ বলে ধান জমিতে জল কিনে দেওয়ার টাকা না থাকাতে; ভাগে নেওয়া বিবর্ণ হলদে হয়ে, শুকিয়ে যাওয়া ধান জমি দেখে সহ্য করতে না পেরে বিষ খেয়েছে লুতফার। বছর ছাব্বিশের এই তরুণ কৃষক, তার পাশেও কি এই বিল ছিল যা আমরা দেখিনি, বা দেখেও গুরুত্ব দিই নি। জল কেন কিনতে হত? কাদের কাছে ডীপটি কল ছিল? কাদের টাকা দিয়ে জমিতে জল কিনতে হত; এই প্রশ্ন কোনোদিন সেভাবে করা হয়ে ওঠেনি। তবে হঠাৎ অনুপমের এই কাজটি দেখে কতো জটিল ল্যান্ডস্কেপে ঢুকে গেলাম; যে বিস্তীর্ণ ধান জমি নিয়ে রোম্যান্টিসাইজ করতাম তা যেন এক মুহূর্তে লুতফারের শুকিয়ে যাওয়া ধান জমির মতো বিবর্ণ হয়ে উঠলো। আরো অসংখ্য দেখাকে অদেখা করে, সহজ সমীকরণের ধূর্ত বোঝাগুলোই যেন নানা জটিল প্রশ্ন নিয়ে অন্য এক জিজ্ঞাসা তৈরি করলো।

ল্যান্ড-গার্ড ৫; ৬/৯ ফিট; ত্রিপল

এবারে আসি চতুর্থ ছবির প্রসঙ্গে। এই ছবিটিতে আমি মৃত্যুকে চোখ রাঙিয়ে আরেক ধরণের অদম্য জীবনের খোঁজ পাই। একটা পড়ে থাকা ঢালাই মেশিনকে দেখি আমরা। যেন প্রাগৈতিহাসিক গল্পের মতো জংলা জীবন; গাছপালা, লতাগুল্ম প্রতিশোধের মতো করে যেন; সময়ের সাথে সাথে তার আদিম হিংস্রতা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে সভ্যতার এই নির্মাণ যন্ত্রটিকে। এক কালে যাতে সিমেন্ট গোলা হতো সেই ড্রামটির মধ্যে বাসা করে নিয়েছে জংলি শেয়াল। 

এই ল্যান্ডস্কেপে ঢালাই মেশিনটিকে অসহায় লাগবে। যেটি একসময় সভ্যতার আগ্রাসন নিয়ে এই প্রাকৃতিক ভূমিকেই সাফ করে ইমারত বানিয়ে গেছে; কিন্তু সময় আসলে প্রকৃতির আরও সুতীব্র আদিম আগ্রাসনের ইতিহাস বহন করে। আমরা পথ চলতি সাইনবোর্ড, অনেক উঁচু বিদ্যুতের খুঁটি, টাওয়ার, কিংবা পড়ে থাকা কংক্রিটে লতা গুল্মর বেয়ে ওঠা, গ্রাস করে নেওয়ার দৃশ্য সচরাচর দেখেই থাকি। কোনও কংক্রিটের বাড়িকে প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিলে প্রকৃতি আবার সেখানে গুল্মলতা দিয়ে শুরু করে বৃক্ষ ফুঁড়ে উঠে, ডালপালা শেকড়-বাকড় নিয়ে বেড়ে উঠে তার আপন মহিমায়। দেওয়াল এফোঁড়-ওফোঁড় করে দেওয়ার দৃশ্যও আমাদের অদেখা নয়। আমরা মানুষেরা যে সভ্যতার দম্ভ নিয়ে, পারমাণবিক আবিষ্কারের অহং নিয়ে জমিন আসমানের দখলদারিত্ব ভোগ করি, আমরা জানিই না আমাদের আগ্রাসন-দম্ভ প্রকৃতির সামনে কিছুই নয়। নইলে চেরনোবিলের পরিত্যক্ত ভূমিকে প্রকৃতি কিভাবে রিক্লেম করে ছিনিয়ে নিতে পারে সে-সত্য আজ আমাদের সামনেই। তথাকথিত সভ্য মানুষের সভ্যতার উৎকৃষ্ট আবিষ্কার পারমাণবিক তেজষ্ক্রিয়তাকে হারিয়ে দিয়ে প্রকৃতি নিজের লুঠ হয়ে যাওয়া জমিকে পুনরুদ্ধার করে নিয়ে নতুন জন্ম আর জীবনের  সাক্ষ্য দিয়ে চলে সভ্যতার আদিম থেকে বর্তমান পর্যন্ত।

ল্যান্ড-গার্ড ৫; ৬/৯ ফিট; ত্রিপল

এবারে আসি শেষ ল্যান্ডস্কেপে। এটি আসলে চিত্রশিল্পী অনুপমের এই সিরিজের প্রথম কাজ। এটি খুবই তাৎপর্য বহন করে পরবর্তী আঁকা ছবিগুলির জন্য। ল্যান্ড-গার্ড সিরিজের এই ছবিটি যখন আঁকা হচ্ছে তখন সদ্য সদ্য অনুপম রাজনৈতিককর্মী হিসেবে বীরভূমের দেওচা পাচামির অসংখ্য ছোট ছোট গ্রামে গ্রাফিতি করে ফিরে এসেছে, এশিয়ার বৃহত্তম খোলা মুখ কয়লা খনি মাইনিং-এর বিরোধে গ্রামবাসীদের আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে।  

রাজ্যের শাসক মানুষদের যখন বোঝাচ্ছে আগামী একশো বছরের বিদ্যুৎ রাজ্যের সঞ্চয়ে থাকবে, উন্নয়নের স্বার্থে এই খোলা মুখ কয়লা খনির দৌলতে। গ্রামবাসীরা আন্দোলনে প্রশ্ন তুলছেন কাদের উন্নয়ন? উৎপাদিত বিদ্যুতের সব থেকে বড় ভাগ কারা ভোগ করে? কোন কর্পোরেট শক্তির সাথে গাঁটছড়া বেঁধে এই মাইনিং প্রকল্প সম্পন্ন হবে? সেখানে কর্পোরেটের লভ্যাংশ কত ? এমন অসংখ্য প্রশ্ন। একই সাথে জল জঙ্গল জমিন সমেত নিজেদের কৌম সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার সপক্ষে গ্রামবাসী অসম লড়াইয়ে লড়ছিলেন। একজন রাজনৈতিক শিল্পী হিসেবে এই লড়াইয়ের পাশে থাকা ও নিজের সামর্থ্য অনুসারে সমর্থন নেওয়া একটি স্ট্যান্ড। যেটা শিল্পী আন্দোলনকারী গ্রামবাসীদের সাথে মিলে বিভিন্ন গ্রামে গ্রাফিতি করে তার সামর্থ্য অনুযায়ী এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন। এছাড়াও ওই অঞ্চলগুলিতে তার নিজের পার্টির রাজনৈতিক কাজ হিসেবে ২০১১/ ১২ থেকে পাথর খাদানের শ্রমিকদের সাথে থাকা, যাওয়া-আসা ছিল। এই ল্যান্ডস্কেপটি ফিরে আসার পর তাঁর ওই অঞ্চলকে দেখা বোঝার জায়গা থেকেই জন্ম নেয়। এই ল্যান্ডস্কেপে একদম সামনে একটি পরিবার দেখা যায়; যারা তাঁদের জমি বা দেশ ছেড়ে পরিযায়ন করছেন। তাঁদের রেফারেন্স অনুপম ব্যবহার করেছে রামকিঙ্কর বেইজের বিখ্যাত সান্থাল ফ্যামিলি থেকে। পার্সপেক্টিভে এই মানুষগুলি সামনে থেকেও আকৃতিতে ছোট। ছবিটিতে জমির বিস্তার, উঁচু-নিচু, খোদাই করা জমি। যেমন মাইনিং অঞ্চলের হয়ে থাকে। এই তিন জনের একজন পুরুষটি সামনের দিকে তাকিয়ে মানে অজানা ভবিষ্যতে; মহিলাটি পিছনের ছেড়ে যাওয়া জানা অতীতের দিকে চেয়ে। আর কোলের বাচ্চাটি তার জমিনের দিকে চেয়ে। এই ছবিটি দর্শককে আলপথ, উঁচু-নিচু পাথর খোদাইয়ের জমি পেরিয়ে অনেকখানি ভিতরে ঢুকতে দেয়। যা আসলে ছবির মধ্যে ঢুকে গিয়ে ওই ল্যান্ডকে অধিকার করার একটা প্লেজার/আত্মসুখ দেয়। যে কারণে ছবিটি প্রদর্শনকালে আমি নিজে ও অন্য দর্শকদেরকেও এই ল্যান্ডস্কেপ দেখে অনেকটা সময় ধরে তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা; এবং একটি হিংস্রতার ছবিকেও অপূর্ব বলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হতে দেখি বারংবার। এই দেখা, দর্শকের অবাধে এই ল্যান্ডস্কেপের ভিতরে ঢুকে যাওয়ার প্রবণতা শিল্পীকে রাজনৈতিকভাবে অস্থির করে তোলে। তার সাথে কথাসূত্রে বারবার সে তুলে আনে একটি বড় কথা ‘কর্পোরেট মাইনিং ন্যাচারাল রিসোর্স; উই আর্টিস্ট/ একাডেমিক মাইনিং সাবল্টারন এক্সপিরিএন্স’ ।

এই ছবিটির পরবর্তী সময়ে আঁকা চারটি ছবিগুলির পার্সপেক্টিভে বড় বদল আনে। চিত্রশিল্পী অনুপম সুচিন্তিতভাবে ল্যান্ডস্কেপের দূর বিস্তারকে প্রশ্ন করে; নিজের এবং দর্শককের ঢুকে যাওয়ার জায়গাকে আটকে দেওয়ার চেষ্টা করে। বদল আনে স্ট্রোকের ডিটেলিং-এর ক্ষেত্রে। আসমান জমিনের ডিস্ট্রিবিউশনে। আর দর্শক দূরে গিয়ে মোষের চোখে ফিরে আসে, বাধ্য হয় ফিরতে। অনুপমের এই নতুন কাজগুলিতে ল্যান্ডস্কেপে চরিত্রগুলি মিশে যেতে থাকে। তারই অংশ হয়ে ওঠে। এই কাজগুলো নিয়ে যখন লেখা শুরু করি; অজান্তে মনের মধ্যে বারবার সমসাময়িক আমাদের প্রিয় গায়ক কফিল আহমেদের গানের লাইন ফিরে ফিরে আসে ̶-

ল্যান্ড-গার্ড ১; ৯/৯ ফিট; ত্রিপল

লেখার শেষ অংশে এসে এটুকু উল্লেখ করা জরুরি, আমি এই লেখাটা লিখতে দীর্ঘ সময় নিয়েছিলাম। এই কাজগুলি নিয়ে দর্শক হিসাবে, এবং কাজগুলির গড়ে ওঠা, এবং তা নিয়ে শিল্পীর সাথে অসংখ্য আলোচনা আমাকে এই লেখাটি লেখার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। এছাড়াও শিল্পী অনুপম রায়ের সাথে পরিচয়ের অনেক আগে থেকে যাদবপুর ক্যাম্পাসের দেওয়াল; আমাদের কৃষ্ণনগর, ও নদিয়ার বেশ কিছু গ্রামে তাঁর রাজনৈতিক দেওয়াল আঁকা দেখে প্রভাবিত হই। তাঁর রাজনৈতিক পোস্টার ও ছবির রাজনীতি দ্বারাও আমি তাড়িত বহুদিন যাবত। তাই এই লেখাটি প্রভাবমুক্ত থেকে আনকোরা দর্শক হিসেবে ও আমার শিল্পানুভূতির জায়গা থেকে লিখতে ও বুঝতে চেয়েছি। আপাতত শিল্পী অনুপম রায়ের এই পাঁচটি কাজ নিয়ে প্রাথমিক দেখাটুকুকে লিপিবদ্ধ করা রইলো আগামীতে আরো বিস্তৃত পরিসরে আলাপ জারি রাখার জন্য।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে