সর্বশেষ কুলপতির প্রস্থান

0
595
এ-বছর শিল্পী সফিউদ্দীন আহমেদের জন্মের শতবর্ষ পূর্ণ হলো। এ-দেশের পথিকৃৎ শিল্পীদের অন্যতম তিনি। বাংলাদেশের আধুনিক ছাপচিত্রের জনক। রেখাচিত্র, ছাপচিত্র ও তেলচিত্র এই তিন মাধ্যমেই অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। জন্ম ১৯২২ সালে কলকাতায়, মৃত্যু ২০১২ ঢাকায়। এর মাঝে ব্যাপ্ত এক বিশাল কর্মময়, ধ্যানমগ্ন, বর্ণাঢ্য শিল্পীজীবন। তাঁর মৃত্যুর অব্যবহিত পরই আবুল হাসনাত সম্পাদিত কালি ও কলমের বিশেষ সংখ্যায় শিল্প সমালোচক আবুল মনসুরের এই লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল। জয়নুল আবেদিনের সমসাময়িক সফিউদ্দীন আহমেদ তার সময়কালে শিল্পচর্চার কোন ধারাটিকে পরিপুষ্ট করে গেছেন এই লেখায় লেখক তা উন্মোচন করেছেন। বলা যায় , এই মূল্যায়ন সমকালীন শিল্প বিশ্বের একজন উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধির উপর আলো ফেলেছে। তাঁকে সমগ্র পাঠকের সামনে হাজির করেছে। লেখাটিতে সফিউদ্দীন আহমেদের সময়কালে চল্লিশের দশকের শিল্পীসাথীদের ও সে-সময়ে দেশের উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের কাজের প্রবণতার সাথে তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য ও বিশিষ্টতাকে চিহ্নিত করেছেন--- যা এই লেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। গুরুত্ব বিচার করে চিত্রসূত্রের পাঠকদের জন্য লেখাটি আবার প্রকাশিত হলো।

আমাদের দৃশ্যকলা জগতের প্যাট্রিআর্ক বা কুলপতিজনদের সর্বশেষ প্রতিনিধি চলে গেলেন। তাঁর, অর্থাৎ সফিউদ্দীন আহমেদের, প্রয়াণ অনেকগুলি বন্ধনগ্রন্থি ছিন্ন করে দিয়ে গেল। প্রথমত, বিগত শতকের চল্লিশের দশকে কলকাতার আর্ট স্কুলে শিক্ষানবিশিতে শামিল হয়ে যে ক’জন বাঙালি মুসলমান ভারতের আধুনিক দৃশ্যকলাজগতে নিজেদের যুক্ত করেছিলেন এবং সাতচল্লিশের দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে চারুকলাচর্চার সূচনায় নানাভাবে অবদান রেখেছিলেন তাঁর বিদায়ে সে-প্রজন্মের সঙ্গে আমাদের প্রত্যক্ষ যোগের অবসান হলো। এ-তালিকায় অন্যদের মধ্যে রয়েছেন জয়নুল আবেদিন, শফিকুল আমিন, আনোয়ারুল হক, খাজা শফিক আহমদ, কামরুল হাসান, হাবিবুর রহমান ও আরো কেউ কেউ। শফিকুল আমিন ছাড়া এঁরা সকলেই প্রয়াত হয়েছেন বিগত শতকে। শফিকুল আমিন বেঁচে থাকলেও চারুকলা জগতের সঙ্গে তাঁর সংযোগ বিশেষ ছিল না। ফলে সফিউদ্দীন একাকী একটি কালপর্বের প্রতিনিধি হয়ে বিরাজমান ছিলেন বেশ অনেকটা সময়কাল ধরে। ঢাকাকেন্দ্রিক চারুশিল্পচর্চার পরিমন্ডলটির সঙ্গে কলকাতার চারুকলা-জগতের যে ঐতিহাসিক সম্পর্কটি রয়েছে তার শেষ প্রতিনিধির বিদায়ে সেটিরও আর প্রত্যক্ষ সংযোগ রইল না। এঁদের অনেকের শিক্ষক মুকুল দে, রমেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, বসন্তকুমার গঙ্গোপাধ্যায়, সতীশচন্দ্র সিংহ, প্রহ্লাদ কর্মকার, আবদুল মঈন প্রমুখের সম্পর্কে যে সশ্রদ্ধ উল্লেখ এঁরা করতেন, তা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যাবে।

জড়জীবন, ১৯৫৭
মাধ্যম- এচিং

দ্বিতীয়ত, এঁদের প্রস্থানের মধ্য দিয়ে অবসান হলো নিবেদিত ও প্রতিষ্ঠান-অন্তঃপ্রাণ শিল্পী-শিক্ষক গোত্রের একটি প্রজন্মের, যেরকমটি এখন বিরল হয়ে উঠেছে। জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দীন, আনোয়ারুল হকদের কাছে তাঁদের শিল্পীসত্তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ ছিল না নিজেদের শিক্ষকসত্তা এবং তাঁদের শিক্ষাদান ছিল অনেকটাই প্রাচীনকালের গুরু-শিষ্য সম্পর্কের মতো ছাত্রদের সঙ্গে একটি আত্মিক নৈকট্যের ভেতর দিয়ে। হয়তো শিল্পের বুদ্ধিবৃত্তিক রসদ তাঁদের কাছে তেমন ছিল না, কিন্তু উপকরণ ও মাধ্যমকে আত্মস্থ করে সৃষ্টির আনন্দকে সবার সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার একটি স্বাস্থ্যোজ্জ্বল পরিবেশ তাঁরা নির্মাণ করতে পেরেছিলেন। এর ফলে এঁদের হাত ধরে একেবারে সূচনাপর্বে বাংলাদেশের শিল্পজগতে একঝাঁক প্রতিভাবান তরুণ শিল্পীর আবির্ভাব ঘটতে পেরেছিল। আজকে বাংলাদেশের শিল্প-শিক্ষালয়গুলির সাধারণভাবে যে মলিন চেহারা তার অন্যতম কারণ নিবেদিত শিক্ষক ও সৃজনের আনন্দঘন পরিবেশের অভাব।

সামান্য চিত্রশিল্পীর গুরুত্ব এদেশে কতটুকুইবা। সেটুকু হয়েই জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান বা সফিউদ্দীন আহমেদ সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছিলেন।

সামান্য চিত্রশিল্পীর গুরুত্ব এদেশে কতটুকুইবা। সেটুকু হয়েই জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান বা সফিউদ্দীন আহমেদ সমগ্র জাতির শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম আদায় করতে পেরেছিলেন। জয়নুল আবেদিন ছিলেন এদেশের সবচেয়ে খ্যাতিমান ও সর্বাগ্রগণ্য নাগরিকদের একজন, কামরুল হাসান রাজনৈতিক সংগ্রামে অন্যতম দিশারি ও সাহসী সৈনিক, সফিউদ্দীন জনজীবনের ঘটনাচক্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও শুধু তাঁর সৌম্য ব্যক্তিত্বের দ্বারা হয়ে উঠেছিলেন সর্বজনের শ্রদ্ধাভাজন। এখনকার চারুশিল্পীদের মধ্যে দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া এমনটি দেখা যাবে না। সফিউদ্দীন আহমেদের তিরোধানের মধ্য দিয়ে বলা যায় একটি সম্ভ্রান্ত শিল্পী-প্রজন্মেরও অবসান ঘটল।

বিহার ল্যান্ডস্কেপ ১৯৪০, মাধ্যম- কাঠখোদাই

বরং জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর পাশাপাশি সফিউদ্দীন আহমেদ ও আনোয়ারুল হকের চিত্রেই আমরা কলকাতাভিত্তিক শিল্পধারায় সর্বপ্রথম দৈনন্দিন জীবন ও ভূদৃশ্যের বাস্তববাদী রূপায়ণ লক্ষ করি।

অনেক দেরিতে হলেও সফিউদ্দীনের প্রয়াণের পর তাঁর সম্পর্কে একটি প্রয়োজনীয় কথা বলার সময় এসেছে। জয়নুল আবেদিন-সফিউদ্দীনদের সময়কালে কলকাতার চিত্রচর্চায় প্রতিনিধিত্বশীল ভূদৃশ্য বা নৈমিত্তিক জীবনদৃশ্য অঙ্কনের রেওয়াজ খুব বেশি ছিল না। অবশ্য দেবীপ্রসাদ রায়চৌধুরী, অতুল বসু, গোপাল ঘোষ, অবনী সেন, গোবর্ধন আশ, মুরলীধর টালি, হরেন দাস এবং আরো কারো কাজে প্রকৃতি ও শ্রমজীবী মানুষের বাস্তববাদী রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। তবে এসব শিল্পীর কাজে প্রত্যক্ষতার ছোঁয়া থাকলেও তাঁদের আঁকা ভূদৃশ্য পুরোপুরি নৈমিত্তিক বাস্তবতা হয়ে উঠতে পারেনি, কদাচিৎ তা প্রকৃতির রূপবিভঙ্গের আবেগাক্রান্ত অতিশায়নকে অতিক্রম করতে পেরেছে। বরং জয়নুল আবেদিন এবং তাঁর পাশাপাশি সফিউদ্দীন আহমেদ ও আনোয়ারুল হকের চিত্রেই আমরা কলকাতাভিত্তিক শিল্পধারায় সর্বপ্রথম দৈনন্দিন জীবন ও ভূদৃশ্যের বাস্তববাদী রূপায়ণ লক্ষ করি। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ইসলামি চিত্রশিল্পের একটি পাকিস্তানি ধারা তৈরি করার যে-প্রয়াসটি ঘটেছিল পারসিক ও ভারতীয় অনুচিত্র আর ইসলামি লিপিকলা বা ক্যালিগ্রাফি চর্চার মধ্য দিয়ে, তার কোনোটির সঙ্গেই বাঙালি মুসলিম শিল্পীর তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। ফলে একেবারে প্রথম প্রজন্মের শিল্পী জয়নুল ও তাঁর সঙ্গীরা দৃশ্যকলার এ ইসলামিকরণের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন এবং বিকল্প হিসেবে পূর্ব বাংলার প্রকৃতি ও নৈমিত্তিক বাস্তবতার রূপায়ণে মনোযোগ দিয়েছেন। পঞ্চাশের দশক থেকে ঢাকায় প্রশিক্ষিত তাঁদের ছাত্ররা নতুন বিকল্প হিসেবে পশ্চিমের শিল্পরূপ থেকে প্রেরণা গ্রহণ করে আঙ্গিকভিত্তিক শিল্পনির্মাণের মাধ্যমে প্রতিরোধের ধারাটিকে অব্যাহত রেখেছেন। এ দুইয়ের মধ্যবর্তী জায়গাটিতে যেন একাকী দাঁড়িয়ে আছেন চিত্রী ও ছাপচিত্রকর সফিউদ্দীন আহমেদ।

শরবতের দোকান, ১৯৫৪, মাধ্যম- তেলরঙ

যে-ধরনের ছবি সহজেই দর্শককে আকর্ষিত করে, সফিউদ্দিনের চিত্রকর্ম সে-ধরনের নয়।

চিত্ররচনের ধারাতেও সফিউদ্দীন তাঁর সমসাময়িকদের থেকে নিজের ভিন্নতা নির্মাণ করেছেন। যে-ধরনের ছবি সহজেই দর্শককে আকর্ষিত করে, সফিউদ্দিনের চিত্রকর্ম সে-ধরনের নয়। জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান বা এস এম সুলতান এঁকেছেন মূলত মানুষ ও প্রকৃতিবিষয়ক দৃশ্যচিত্র, কিছু অতিশায়ন থাকলেও মূলত বাস্তব দৃশ্যপটের বয়ান। বোধগম্য ভাষায় মানুষের আত্মশক্তির ছবি। জয়নুল এঁকেছেন ভীষণা প্রকৃতির দুর্বিনীত শক্তির বিরুদ্ধে অথবা ক্ষমতাধরের হীন চক্রান্তে বিপর্যস্ত হয়েও অজেয় মানবের লড়াইয়ের শক্তিমান ভাষ্য। মানুষ তাঁর ছবিতে নিজকে আবিষ্কার করে, চিনে নেয় নিজের জীবন-সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। ফলে তাঁর ছবি মানুষকে টানে এক অন্তর্নিহিত ক্ষমতায়। কামরুল হাসানের ছবিও সাধারণ দর্শককে টানে, তবে এখানে মানুষ দেখে তাঁর হারিয়ে যাওয়া পল্লীজীবনের এক স্বপ্নিল ও স্মৃতিবিধুর দৃশ্যপট। লোকচিত্রের আদলে সহজ উপস্থাপনায় ও বর্ণিল চেহারার জৌলুসে তাঁর ছবি সব ধরনের দর্শককেই সহজে আকর্ষণ করতে পারে। তিনি যখন রাজনৈতিক বক্তব্য-সংবলিত ছবি আঁকেন বা ছবির মানব-অবয়বে কিছু অতিরঞ্জন বা ব্যত্যয় ঘটান, তখনো উপস্থাপনার বর্ণাঢ্যতায় তা দর্শকের কাছে সহজেই উপভোগ্য হয়ে ওঠে। সুলতানের ছবিতে মানব-অবয়বের অতিরঞ্জন বা পেশির অস্বাভাবিক উপস্থাপন সত্ত্বেও চিরায়ত পল্লীজীবনের অতিচেনা দৃশ্যপট সাধারণ দর্শককে আকৃষ্ট করে। এখানেও মানুষ নিজের শক্তিময়তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।

বন্যা, ১৯৯৪, মাধ্যম- চারকোল

চল্লিশের দশক থেকে ভারতবর্ষে এবং পঞ্চাশের দশক থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমা শিল্প-আন্দোলনগুলির প্রভাবে দৃশ্যকলার আঙ্গিকে যে পালাবদলের সূচনা ঘটেছিল জয়নুল-কামরুল-সুলতানরা তাঁর সঙ্গে নিজেদের মেলাননি বা সে বিবর্তনের সাথি হননি।

সমসাময়িকদের মতো সফিউদ্দীনের ছবি বয়ানধর্মী ঘরানার নয়। জয়নুল-কামরুল-সুলতান তাঁদের নিজ নিজ স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও পরবর্তীকালে চল্লিশের দশকের সাদৃশ্যধর্মিতার মূল চারিত্র্যলক্ষণ থেকে পুরোপুরি পৃথক হতে পারেননি। আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে, চল্লিশের দশক থেকে ভারতবর্ষে এবং পঞ্চাশের দশক থেকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমা শিল্প-আন্দোলনগুলির প্রভাবে দৃশ্যকলার আঙ্গিকে যে পালাবদলের সূচনা ঘটেছিল জয়নুল-কামরুল-সুলতানরা তাঁর সঙ্গে নিজেদের মেলাননি বা সে বিবর্তনের সাথি হননি। সুলতান সে-চেষ্টাই করেননি, তবে জয়নুল-কামরুলের মধ্যে চেষ্টা যে ছিল না তা নয়। এ-কথার অর্থ, জয়নুল আবেদিন বা কামরুল হাসানের চিত্রকর্মের কোনো অবমূল্যায়ন নয়, সময়ের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন শিল্পীর মানসপটটিকে বোঝার চেষ্টা করা মাত্র। জয়নুল আবেদিন এক পর্যায়ে তাঁর চিত্রে আমাদের লোকশিল্পের অনুষঙ্গ যুক্ত করে চমৎকার কিছু কাজ করেছেন; কিন্তু সেটিকে তাৎপর্যময় কোনো পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার মতো অভিনিবেশ দেননি। কামরুল হাসান বরং লোকশিল্পের আঙ্গিকের সঙ্গে কিউবিজমের কিছু বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, তাঁর শেষদিকের কাজে ফ্যান্টাসির ব্যবহারেও সমকালের শিল্পরূপের ছাপ পরিদৃশ্যমান। তবু বলতে হয়, পরিবর্তনশীল শিল্পভাবনার মূল স্রোতের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার জন্য যে বিপুল রূপান্তর প্রয়োজন ছিল জয়নুল বা কামরুল, তাঁদের কালজয়ী কিছু শিল্পকর্ম সত্ত্বেও, সেটিতে শামিল হননি। অর্থাৎ বিংশ শতাব্দীর সূচনা থেকে চল্লিশের দশক পর্যন্ত এ-উপমহাদেশের আধুনিক শিল্পরূপটি যে-বিশেষ চারিত্র্যলক্ষণে প্রকাশিত হয়েছিল, জয়নুল আবেদিন, কামরুল হাসান ও এস এম সুলতান, তাঁদের উল্লেখযোগ্য বিশিষ্টতা সত্ত্বেও, সে-শিল্পধারার প্রতিনিধি হিসেবেই রয়ে গেছেন।

ময়ূরাক্ষীর তীরে, ১৯৫৪
মাধ্যম- ড্রাই পয়েন্ট

এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট-এনগ্রেভিংয়ের কঠিন টেকনিক-নির্ভর শিল্পমাধ্যমে হেটার নিয়ে এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দোময় রেখার বিন্যাস যা ইতোপূর্বে সম্ভব বলে বিবেচনা করা হয়নি।

এখানে সফিউদ্দীন ব্যতিক্রম এবং তাঁর চল্লিশের দশকের সাথিদের থেকে পৃথক। জয়নুল-কামরুলের মতো সাদৃশ্যধর্মী দৃশ্যপট সফিউদ্দীনও চল্লিশের দশক ও পঞ্চাশের প্রথমার্ধ জুড়ে এঁকেছেন, অন্যদের মতোই তাতে কিছুটা বেঙ্গল স্কুলের প্রভাব, কিছু লোকশিল্পের সরলীকরণ, কিছু ইমপ্রেশনিজমের অনুপ্রেরণা দেখা যাবে। ১৯৫৮ সালে সফিউদ্দীন ছাপাই ছবিতে উচ্চতর প্রশিক্ষণলাভের জন্য লন্ডনের সেন্ট্রাল স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফটসে ভর্তি হন। বলা যেতে পারে যে, এখান থেকেই সফিউদ্দীন সংগ্রহ করলেন উত্তরণের রসদ, এখান খেকেই রচিত হতে শুরু করলো সমসাময়িকদের সঙ্গে তাঁর পার্থক্যের লক্ষণসমূহ। উল্লেখ্য, জয়নুল আবেদিন অল্প কিছুদিন লন্ডনের স্লেড স্কুলে কাজ করলেও এটি ঠিক উচ্চতর প্রশিক্ষণ নয়। কামরুল ও সুলতান পশ্চিমে কোনো প্রশিক্ষণ নেননি। এখানেও সফিউদ্দীন ব্যতিক্রম। তিনি পুরোপুরি ছাত্র হিসেবে বিশ্বখ্যাত ছাপচিত্রী হেটারের শিষ্য মার্লিন ইভান্সের অধীনে সেন্ট্রাল স্কুল থেকে এচিং ও এনগ্রেভিংয়ে ডিপ্লোমা নিয়েছেন। এচিং-অ্যাকুয়াটিন্ট-এনগ্রেভিংয়ের কঠিন টেকনিক-নির্ভর শিল্পমাধ্যমে হেটার নিয়ে এসেছিলেন স্বতঃস্ফূর্ত ছন্দোময় রেখার বিন্যাস যা ইতোপূর্বে সম্ভব বলে বিবেচনা করা হয়নি। টেকনিক বা শৈলীর কুশলতা ও পরিশীলনের প্রতি আজীবন আগ্রহী সফিউদ্দীনকে ছাপাই ছবিতে রেখার এ বেগবান প্রকাশময়তা ভীষণভাবে আকর্ষণ করেছিল, যে-আকর্ষণ তাঁর বাকি জীবনের শিল্পকর্মে অন্যতম বৈশিষ্ট্য হয়ে বিরাজ করছে।

গাছ -২, ২০০৪, মাধ্যম-চারকোল

আমাদের দেশে চিত্রপটের বিমূর্ত-বিন্যাসের আঙ্গিকধর্মী ধারাটির পথিকৃৎ হিসেবে যাঁদের বিবেচনা করা হয় – আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া কিংবা হামিদুর রহমান, এঁদের পাশে সফিউদ্দীন আহমেদ নামটিও খোদিত হলে বোধহয় অধিকতর শোভন হয়।

এটি লক্ষ করবার মতো যে-জীবনাচারে বা অন্যান্য বহু বিষয়ে সফিউদ্দীন মূলত চল্লিশের দশকে প্রচলিত ধারাপন্থী বলেই প্রতীয়মান হন; শিল্প-উপকরণ ও কৃৎকৌশল ব্যবহারের ক্ষেত্রেও তিনি যথেষ্ট রক্ষণশীল। কিন্তু শিল্পভাবনার বিবর্তনে তাঁর সমসাময়িকদের তুলনায় তিনি অনেকখানি প্রাগ্রসর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন, রীতিমতো বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটিয়েছেন তাঁর শিল্প-আঙ্গিকে। চিত্রতলকে ত্রিমাত্রিক দৃষ্টিবিভ্রম রচনার ও দৃশ্যবর্ণনার ক্ষেত্র হিসেবে দেখবার দীর্ঘলালিত ঐতিহ্যকে বর্জন করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চল্লিশের দশকের শিল্পীদের মধ্যে একমাত্র তিনিই একে দেখতে চেয়েছেন দ্বিমাত্রিক তলে রেখা, আকৃতি ও বর্ণের সুসমঞ্জস বিন্যাস হিসাবে। বিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে চিত্রে বিষয়ের খবরদারি কমিয়ে আঙ্গিককে গুরুত্বপূর্ণরূপে বিবেচনার যে-ফর্মালিস্ট বা আঙ্গিকধর্মী শিল্পদর্শন প্রবল হয়ে উঠেছিল এদেশের শিল্পধারায় তাকে রোপণ করবার কাজে পথিকৃৎদের অন্যতম সফিউদ্দীন আহমেদ এ কথাটি আমরা তেমন উচ্চকণ্ঠে কখনো বলিনি। পশ্চিমের শিল্পধারার সরাসরি সংস্পর্শে আসার আগেই সফিউদ্দীনের ১৯৫৪-তে করা ‘শূন্য ঝুড়ি’ ও ‘শরবতের দোকান-১’ তেলচিত্রে এবং ১৯৫৭-র এচিং অ্যাকুয়াটিন্ট ‘জড়জীবনে’ দেখি আকৃতির জ্যামিতিক সরলায়ন ও চিত্রপটকে দ্বিমাত্রিক ক্ষেত্র হিসেবে বিন্যাসের প্রয়াস। আমাদের দেশে চিত্রপটের বিমূর্ত-বিন্যাসের আঙ্গিকধর্মী ধারাটির পথিকৃৎ হিসেবে যাঁদের বিবেচনা করা হয় – আমিনুল ইসলাম, মোহাম্মদ কিবরিয়া কিংবা হামিদুর রহমান, এঁদের পাশে সফিউদ্দীন আহমেদ নামটিও খোদিত হলে বোধহয় অধিকতর শোভন হয়। সফিউদ্দীন আহমেদ চল্লিশের দশকের দেশবিভাগ-পূর্বকালীন আখ্যানধর্মী শিল্পধারার পুঁজি নিয়ে পরবর্তীকালের একেবারে বদলে যাওয়া শিল্পরূপের পরম্পরার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেছেন। তাঁর সমসাময়িকদের থেকে এখানে তিনি ব্যতিক্রম এবং চল্লিশের বয়ানধর্মী শিল্পধারা আর পঞ্চাশ থেকে সূচিত আঙ্গিকপ্রধান শিল্পধারার মধ্যে একমাত্র সেতুবন্ধ। আমাদের শিল্প-ইতিহাসে তাঁর এ-গুরুত্বটি যথাযথ স্বীকৃতিতে প্রতিষ্ঠিত করবার মাধ্যমেই আমরা প্রয়াত এই শিল্পগুরুর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধাকে তাৎপর্যময় করে তুলতে পারি।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে