বাংলাদেশে জাতীয় চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা

0
768

জাতীয় চলচ্চিত্র: অবতরণিকা

চলচ্চিত্র পাঠের জগতে জাতীয় চলচ্চিত্র একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। চলচ্চিত্রের ইতিহাসকে বোঝার জন্যে এই ধারণাটি শ্রেণিবিন্যাসের একটি ধারা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, চলচ্চিত্রকে একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং জাতিতত্ত্বমূলক কার্যক্রম হিসেবে পাঠ করার ক্ষেত্রে জাতীয় চলচ্চিত্র একটি প্রধান প্রত্যয়। নানাভাবে জাতীয় চলচ্চিত্রের ধারণায় পৌঁছানো যেতে পারে। চলচ্চিত্র বিষয়ক জ্ঞানচর্চায় এর সংজ্ঞায়ন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। কাকে বলা যাবে জাতীয় চলচ্চিত্র, জাতি-রাষ্ট্রের ধারণার সাথে তার সম্পৃক্ততা অথবা পৃথকতা, কখন একটি জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে পরিচালিত হলেও কোন চলচ্চিত্র-কর্মকাণ্ডকে জাতীয় চলচ্চিত্রের মান দেওয়া যাবে না—এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে।

আগ্রহ তৈরি করার মতো ব্যাপকভিত্তিক একটি মত হচ্ছে, “An influential organizing principle in film studies, locating films and cinemas within their national contexts and/or treating a country’s cinematic output as a distinct object of study. There are two underlying assumptions: firstly, that films produced within a particular national context will display some distillation of the historical, social, and political culture of that country; and secondly, that cinema (as one aspect of popular culture) plays a role in the construction of national identity.” (কান ও ওয়েস্টেল: ২০২০)

অর্থাৎ, ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, একটি জাতি-রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলির মধ্যে সেই রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতির কিছু নিদর্শন দেখতে পাওয়া যাবে এবং চলচ্চিত্র জনসংস্কৃতির একটি অংশ হিসেবে জাতীয় পরিচয় নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি ভূমিকা পালন করে থাকে। আমরা এই শর্তগুলোকে মাথায় রেখে বিশ্বে প্রচলিত কয়েক ধরনের জাতীয় চলচ্চিত্রের উপস্থিতি লক্ষ করি। জাতীয় চলচ্চিত্রের এই রকমভেদটি আমরা গ্রহণ করেছি স্টিফেন ক্রফটস-এর “রিকনসেপচুয়ালাইজিং ন্যাশনাল সিনেমাস” প্রবন্ধে জাতীয়-চলচ্চিত্রের যে শ্রেণিকরণ করা হয়েছে তার অনুপ্রেরণায়।

১. ইউরোপীয় আর্ট হাউস সিনেমা যারা হলিউডের চলচ্চিত্র-প্রবণতার চেয়ে চরিত্রে আলাদা, কিন্তু তাদের লক্ষ্য একটি ছোট, আলাদা বাজার (দর্শক); তারা হলিউডের সিনেমার প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। ইউরোপের বাইরেও ষাট ও সত্তরের দশকে এরকম সিনেমার উদাহারণ আছে।

২. ইউরোপ ও তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির বাণিজ্যিক ছবি, নিজস্ব জাতীয় স্পেসে হলিউডের ছবির সাথে যাদের সীমিত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়।

৩. লাতিন আমেরিকার তৃতীয় চলচ্চিত্রের ঘরানার চলচ্চিত্র; তৃতীয় বিশ্বের র‌্যাডিক্যাল সিনেমা।

৪. এমন চলচ্চিত্র যা হলিউডকে পাত্তা দেয় না, এমনকি চ্যালেঞ্জ পর্যন্ত করতে পারে—এর শ্রেষ্ঠ বা সম্ভবত একমাত্র উদাহরণ বলিউড।

৫. এমন চলচ্চিত্র যা একটি রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা অথবা ব্যাপকভাবে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এবং সংরক্ষণের মাধ্যমে বিকশিত হয়; ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ের কমিউনিস্ট দেশসমূহের সিনেমা, গেল কয়েক দশকের ইরানি সিনেমা, সত্তর ও আশির দশকে ভারতে সরকার-প্রযোজিত চলচ্চিত্র ইত্যাদি।

৬. জাতি-রাষ্ট্রের ভৌগোলিক এবং প্রশাসনিক কাঠামোকে অস্বীকার করে প্রান্তিক জাতিসমূহের (সংস্কৃতি ও ভাষার দিক থেকে স্বাতন্ত্র্যের দাবিদার) নিজস্ব সিনেমা।

প্রসঙ্গ: বিউপনিবেশায়ন

বাংলাদেশের মতো ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত রাষ্ট্রে জাতীয় চলচ্চিত্রের বিকাশের চ্যালেঞ্জটি বুঝতে হলে এসব রাষ্ট্রের বিউপনিবেশায়ন এবং আধুনিকায়নের প্রক্রিয়াটি পরিক্রমণের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। বিউপনিবেশায়নের মূল ধারণাটি রাজনৈতিক। বলা যায়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে তার পরবর্তী তিন দশকে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের পতন এবং উপনিবেশসমূহের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ—এই ঘটনাই বিউপনিবেশায়নের মূল কথা। তর্ক করা যাবে অবশ্য, যে, উপনিবেশসমূহে সাম্রাজ্যবিস্তারী শক্তিসমূহের বিরুদ্ধে আরো বহু আগেই অসন্তোষ, আন্দোলন এবং হিংসাত্মক ঘটনার উদাহরণ রয়েছে এবং উপনিবেশের মানুষদের এই দীর্ঘ সংগ্রাম বিউপনিবেশায়নের আকাঙক্ষারই প্রতীক। সে হিসেবে, বিউপনিবেশায়ন এক চলমান প্রক্রিয়া—দীর্ঘকাল, সম্ভবত উপনিবেশ স্থাপনের অব্যবহিত পর থেকেই; গত শতকের শেষার্ধে যার যবনিকাপাত প্রায় সম্পন্ন; বিশ্বজুড়ে।

১৮৫১ সালে শিল্পী এমানুয়েল ল্যুৎজের আঁকা পেইন্টিং ‘ওয়াশিংটন ক্রসিং দ্যা ডেলওয়ার রিভার

রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়নের প্রক্রিয়ায় কতগুলো নতুন শব্দ এবং পদ আবির্ভূত হয়। ‘আধুনিকায়ন’, ‘অনুন্নয়ন’, ‘বিশ্বায়ন’, ‘বিশ্বায়িত পুঁজিবাদ’ সমাজ ও রাজনীতি-চিন্তায় প্রভাববিস্তারী হয়ে ওঠে। বস্তুগত ক্ষেত্রে, রাজনৈতিকভাবে বিউপনিবেশায়িত স্থানে এসব শব্দ এবং পদের কার্যক্রম মানুষের জীবনের প্রায় সার্বিক নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। যেমন আশা করা গিয়েছিল যে, রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়ন অত্যাচারিত মানুষকে অবশেষে ক্ষমতাবান করে তুলবে এবং তারা স্বাধীনভাবে নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে—তেমনটি ঘটে না। এটি ব্যাপকভাবে অনুভূত হয় যে, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক এবং মনস্তাত্ত্বিক বিউপনিবেশায়ন ছাড়া মানুষের সত্যিকার মুক্তি সম্ভব নয়।

আরো একটু পেছনে গেলে লক্ষ করা যাবে, ঔপনিবেশিক শাসন উপনিবেশসমূহের সকল ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস বা অকার্যকর করে নিজেদের আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। ফলে, স্থানিক সকল বস্তুগত ও চিন্তাগত প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত হয়েছিল অথবা ক্ষমতাবানের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়েছিল। উপনিবেশের মানুষ বস্তু ও চিন্তাবিষয়ক হীনম্মন্যতায় আক্রান্ত হয়েছিল এবং উপনিবেশ স্থাপনকারীদের উপস্থিত করা বস্তু ও চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল এবং তাদের উৎকর্ষে আস্থাবান হয়েছিল। এভাবেই আধুনিকতার ধারণাটিও ইউরোপীয় উপনিবেশ-স্থাপনকারীদের একটি প্রকল্প হিসেবে উপনিবেশসমূহে এক একপেশে শ্রেষ্ঠম্মন্যতায় বাস্তবায়িত হয়েছিল।

উপনিবেশ-স্থাপনকারীরা বিশ্বাস করেছে এবং বলতে চেয়েছে, “… only the West developed proper scientific procedures, while Babylonian astronomy lacked a mathematical foundation, Indian sciences lacked rational experiments, Chinese historiography lacked the Thucydidean paradigm and Asian jurisprudence lacked the strict juridical procedures of canonical law; although musical understanding and polyphonic music could be found everywhere in the world, only the West developed rational harmonic music, musical notation, and instruments such as the organ, the piano and the violin; while the principles of pointed arch and dome were known and practiced in the Orient, only the Occident developed them into a systematic style in medieval architecture; print was known in China, but only the West acquired a press; … “। (শুলৎজ-এঙ্গলার: ২০০৭, ৩৭-৩৮)

অর্থাৎ, ইউরোপেই সকল বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সমাজবিদ্যা ও শিল্পকলার শৃঙ্খলাপূর্ণ ও যৌক্তিক উৎকর্ষ অর্জিত হয়েছিল। এই আত্মবিশ্বাস এবং শ্রেষ্ঠম্মন্যতা নিয়ে তারা পূর্ব ও দক্ষিণে তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মনোযোগী হয়েছিল এবং আধুনিকতার প্রকল্প নতুন সাম্রাজ্যে বাস্তবায়িত করতে চেয়েছিল। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। উপনিবেশের সকল স্থানিক প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছিল—বলা গেছে আগেই। উপনিবেশের সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষেরা শিক্ষায় ও জীবনপ্রণালীতে এই একপেশে আধুনিকতার মানদণ্ডে নিজেদের নির্মাণ করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। উপনিবেশকদের পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্র পরিচালনা, আইন, শিক্ষা, অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি-চর্চা এবং শিল্পকলার যেসব প্রতিষ্ঠান নির্মিত হয়েছিল তাদের সকলের আরাধ্য ছিল ইউরোপের আধুনিকতার সমান হওয়া। বলা ভালো, যেসব প্রতিষ্ঠান উপনিবেশকদের ভিন্ন কোনো স্বার্থ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট ছিল তাদের কথা স্বতন্ত্র। যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো এই যে, উপনিবেশের মুষ্টিমেয় সুবিধাপ্রাপ্ত মানুষেরা এই সকল প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হয়ে শিক্ষা ও বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন। তারা অতঃপর স্থানীয় আপামর জনসাধারণের ওপর কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে উঠেছিলেন এবং তারাই শেষ অবধি বিউপনিবেশায়নের রাজনৈতিক সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়ন নতুন পতাকা, মানচিত্র, জাতীয় সঙ্গীত উপহার দিয়েছিল। কিন্তু উপনিবেশকদের গড়া প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতায় একটি স্থানীয় কল্যাণরাষ্ট্র যেখানে সর্বাধিক মানুষের জীবন অর্থপূর্ণ হয়ে উঠবে, তারা তাদের বৃত্তি ও সৃজনশীলতার চূড়ান্ত উৎকর্ষের লক্ষ্যে চালিত হতে পারবে, বিশ্বসভায় তারা তাদের কৃতিত্বের নমুনা উপস্থিত করতে পারবেন—এমনটি গড়া সম্ভব হলো না। কারণ সেসব প্রতিষ্ঠানের আদর্শ ও কার্যক্রমের সাথে স্থানীয় জীবনের নাড়ির যোগ নেই। অন্যদিকে উপনিবেশকদের গড়া প্রতিষ্ঠানসমূহের বিনির্মাণ সহজ কাজ ছিল না। বিশেষ করে, নতুন রাষ্ট্রসমূহের নেতৃত্বে থাকা জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিদ্যমান প্রতিষ্ঠানসমূহের বিষয়ে গভীর আস্থা, অবচেতন বা সচেতন হীনম্মন্যতা এবং বিকল্প চিন্তার সক্ষমতার অভাব এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। আর নতুন যে অভিজ্ঞতা বিউপনিবেশায়ন—উত্তর সময়ে সে হলো ওইসব শব্দ বা পদের আবির্ভাব যাদের কথা উল্লেখ করা গেছে ইতোমধ্যে। ‘আধুনিকায়ন’-এর কথা উঠছে জোরেসোরে; অর্থাৎ, পশ্চিমে উৎপাদিত পণ্যের অপরিকল্পিত ভোগ। ‘অনুন্নয়ন’-এর ব্যবস্থাপত্র হিসেবে কখনও অজৈবিক সার, কখনও উচ্চফলনশীল জেনেটিক্যালি মডিফায়েড বীজ, কখনও পরিত্যক্ত প্রযুক্তির ডাইং কারখানা অথবা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পাওয়া যাচ্ছে। ‘বিশ্বায়ন’ কি দুশো বছর আগের আধুনিকতার প্রকল্পেরই নতুন নাম? পশ্চিমের, অথবা বলা যাক হালে যারা প্রবল নানা পণ্য উৎপাদনে, তার ভেতর সর্বশেষ ডিজিটাল প্রযুক্তিজাত ভোগ্যপণ্য, খাদ্য এবং সাংস্কৃতিক পণ্য, শিক্ষা এবং চিকিৎসা-পণ্য সবই অন্তর্ভুক্ত—তাদের পণ্যের অবাধ প্রবাহের ভেতর দিয়ে এক একশৈলিক বিশ্বমানব সমাজ নির্মাণ—এই কি বিশ্বায়ন? অথবা, এই হচ্ছে বিশ্বায়িত পুঁজিবাদের প্রকাশ্য অবয়ব?

এসকল নেতিপ্রবণতার বিপরীতে সার্বিক বিউপনেবিশয়ানের ধারণার প্রস্তাবনা, বিকল্প আধুনিকতার ধারণার বিবেচনা। উপনিবেশোত্তর অভিজ্ঞতায় দেশে দেশে সচেতন মানুষ, নেতা, শিক্ষক, সমাজকর্মী এবং শিল্পীরা বিউপনিবেশায়নের জরুরি কাজটির পেছনে গত কয়েক দশক ধরে লেগে রয়েছেন। এই লেগে থাকা কখনও ‘জাতি গঠন’- এর প্রকল্প নামে আখ্যায়িত হয়েছে, কখনও নাম পেয়েছে ‘লাগসই প্রযুক্তি’র প্রয়োগ, কখনও বা ‘প্রাসঙ্গিক’ তথা ‘বিকল্প আধুনিকতা’ মনন ও সমাজ নির্মাণ। বিদ্যায়তনিক চর্চায় বিউপনিবেশায়ন এবং বিকল্প আধুনিকতা উপনিবেশোত্তর পাঠের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে।

পশ্চিমের আধুনিকতা ও চলচ্চিত্র

চলচ্চিত্রের আবির্ভাব আর পশ্চিমের শিল্পবিষয়ক আধুনিকতার ধারণা প্রায় সমবয়সী। ঊনবিংশ শতাব্দীতে বোদলেয়ারের শিল্পচিন্তা, গুস্তাভ কুরবের বাস্তববাদী চিত্রকলা, শিল্পে সমকালীন জীবনের খণ্ডচিত্র উপস্থাপন, প্রতিষ্ঠান এবং প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ, উচ্চ ও নিম্ন শিল্পের মধ্যকার পার্থক্যকে অস্বীকার করার প্রবণতা, সকল নব-তরঙ্গের বিষয়ে আগ্রহ—এসবই আধুনিকতার লক্ষণ বলে স্বীকৃত হয়েছে। অর্থাৎ, পশ্চিমের শিল্পে আধুনিকতার আবির্ভাবকে সময় এবং প্রবণতার দিক থেকে নির্দিষ্ট করা যায়।

রাশিয়ার আভাঁ গার্দ সময়কার দুটি চলচ্চিত্রের পোস্টার

অন্যদিকে, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষে চলচ্চিত্র আবিষ্কৃত হয় এবং প্রবণতার দিক থেকে আধুনিক শিল্পের প্রায় সকল লক্ষণকে বহন করে। বাস্তবের প্রামাণ্যকরণ, বিশেষত সমকালীন জীবনের প্রামাণ্যকরণ তার সহজাত ভৌত বৈশিষ্ট্য, উচ্চ শিল্পের শ্রেষ্ঠম্মন্যতা তার নেই; বরং সর্বাধিক মানুষের কাছে পৌঁছনোর জন্যে তার যে প্রাণান্ত চেষ্টা তাতে সাথ দিতে পারে এমন যেকোনো যোগাযোগ কৌশলকে সে সাদর আমন্ত্রণ জানায়; আর, চলচ্চিত্র, সে তো নিজেই এক আভাঁ গার্দ, এক নব তরঙ্গ! অন্যদিকে, চলচ্চিত্রের যে ভৌত অবস্থা তা ভীষণ প্রযুক্তিপ্রবণ এবং এর আবিষ্কারের শুরুতেই যে পেটেন্টবিষয়ক নানা জটিলতা তা আধুনিক পুঁজিবাদী সময়ের মেজাজকেই নির্দিষ্ট করে। আমাদের মনে পড়বে প্রথম প্রদর্শিত চলচ্চিত্র একটি রেলগাড়ি নিয়ে। আমরা জানি যে, রেলগাড়ি পশ্চিমের আধুনিকতার সাফল্যের পতাকাবাহী এক আইকন। পরে বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই চলচ্চিত্র যুক্ত হয়েছে রুশ বিপ্লবের মতো দুনিয়া কাঁপানো ঘটনায়, আর চ্যাপলিন নির্মাণ করেছেন মডার্ন টাইমস। একসময় হলিউডের স্টুডিও সিস্টেমের হাত ধরে চলচ্চিত্র হয়ে উঠেছে পুঁজিবাদী শিল্পের এক সফল নিদর্শন। আবার বিশের দশক থেকেই এক্সপেরিমেন্টাল ফিল্মের ভেতর দিয়ে আভাঁ গার্দ শিল্পচর্চার সমান্তরাল কাজ চলেছে চলচ্চিত্রে।

উপনিবেশে চলচ্চিত্র চলচ্চিত্রের বিউপনিবেশায়ন

এই চলচ্চিত্র যখন এসেছে উপনিবেশে তখন সে উপনিবেশকের প্রযুক্তিগত সাফল্যের দম্ভ, মোহাবিষ্ট করার জাদুকরী ক্ষমতা আর পুঁজিবাদী এজেন্ডাকে একত্রে বহন করেছে। বলা যায়, আধুনিকায়নের যে প্রক্রিয়া উপনিবেশের কালেই শুরু হয়েছিল চলচ্চিত্র ছিল তাতে এক শক্তিমান যোগ। উপনিবেশ চলচ্চিত্রের বড় বাজার নিশ্চিত করেছে, চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতাকে উপনিবেশের বাসিন্দারা ইউরোপ এবং আমেরিকায় নির্মিত গড়পরতা চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতার সমার্থক বলে জেনেছে, পরে যখন উপনিবেশের মানুষেরা চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন তখন তারা সেই অভিজ্ঞতার কাছেই ফিরে গেছেন, তাদের নির্মিত চলচ্চিত্র দেখায় এবং বর্ণনায়, দৃশ্যগত মেটাফোর নির্মাণে স্থানীয় হয়ে উঠতে পারে নি। এভাবে উপনিবেশায়নের প্রকল্পটিরই আরেকটি সফল খুঁটি গাঁথা হয়েছে।

রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়নের পর অন্যান্য অভিব্যক্তি মাধ্যমের মতো চলচ্চিত্রের বিউপনিবেশায়ন একটি জরুরি কাজ হয়ে ওঠে। নতুন রাষ্ট্রগুলোতে কোনো কোনো চলচ্চিত্রনির্মাতারা এ-বিষয়ে সচেতন হয়ে ওঠেন যে, উপনিবেশকালের ধারাবাহিকতায় স্থানীয়ভাবে যে-চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে সেখানে কোনো স্থানিক প্রকাশ-আঙ্গিক গড়ে উঠছে না, স্থানীয় শিল্প-ঐতিহ্যের সাথে এসব চলচ্চিত্রের অভিব্যক্তি যুক্ত হতে পারছে না, সমকালীন স্থানিক সংবেদনকে তাঁরা শিল্পে বিনির্মাণ করতে পারছেন না, নতুন রাষ্ট্রে জাতি গঠনের অধ্যায়গুলির আলোচনা এবং সমালোচনা করতে পারছেন না। উপরন্তু, চলচ্চিত্রের নব্যউপনিবেশবাদ বিস্তৃততর চেহারায় সর্বব্যাপী এবং সর্বগ্রাসী এক সাংস্কৃতিক পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। এই সচেতনতা থেকে চলচ্চিত্রের বিউপনিবেশায়নের প্রচেষ্টার শুরু। বস্তুত, আফ্রিকা, এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে এই উদ্যোগের ফল হিসেবে বিভিন্ন ধরনের প্যারালাল সিনেমা এবং বিকল্প সিনেমার আন্দোলনের সূচনা হয়েছে। এইসব আন্দোলনকেই আমরা এসব দেশে জাতীয় চলচ্চিত্রের সূতিকাগার হিসেবে চিহ্নিত করতে পারি। এরা এমন চলচ্চিত্র-প্রচেষ্টা যা ঔপনিবেশিক অতীতের সাথে অথবা উপনিবেশোত্তর সমসাময়িক সময়ের সাথে সমালোচনামূলক সংলাপে (critical dialogue) যুক্ত হয়। এই চলচ্চিত্র একপেশে বিশ্বায়নের ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু স্থানিক সংবেদনের সমকালীন ব্যাখ্যাকে বিশ্বসভায় তুলে ধরে; বিশ্বায়ন বরং এক রঙধনু, অনেক স্থানিক সম্ভারের এক ঐশ্বর্য—এই মতকে দৃঢ়তা দেয়। এই চলচ্চিত্র ‘গ্লোবালাইজেন’-এর পরিবর্তে ‘গ্লোকালাইজেশন’-এর প্রতি দৃষ্টি দিতে প্রেরণা জোগায়। এমন দৃশ্যসংবেদ সৃষ্টি করতে অনুপ্রাণিত হয় যা স্থানিক বা লোকাল, কিন্তু বিশ্ব পর্যায়ে বা গ্লোবালি সে চলচ্চিত্রের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করে। একই সময় সে সমকালীন এবং আধুনিক।

শিল্পতাত্ত্বিক শিবকুমার বিকল্প আধুনিকতা বা প্রাসঙ্গিক আধুনিকতার প্রস্তাব করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথ, নন্দলাল বসু, বিনোদবিহারি মুখোপাধ্যায় এবং রামকিংকরের শিল্প-প্রচেষ্টায় যে আধুনিকতাকে দেখতে পেয়েছেন তাকে সূত্রায়িত করেছেন এভাবে: “Modernism was to them neither a style nor a form of internationalism. It was critical re-engagement with the foundational aspects of art necessitated by changes in one’s unique historical position”. (শিবকুমার: ২০১৩)

নতুন জাতি-রাষ্ট্রসমূহে জাতীয় চলচ্চিত্র ও প্রসঙ্গ বাংলাদেশ

যেমন বলেছি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত হয়ে যে জাতি-রাষ্ট্রগুলোর জন্ম হয় তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় নির্মাণে জাতীয় চলচ্চিত্র এক প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এশিয়া এবং আফ্রিকার এরকম নতুন জাতি-রাষ্ট্রে চলচ্চিত্রনির্মাতারা অনেক ক্ষেত্রে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় (যেমন ভারতে এন এফ ডি সি-র প্রযোজনায়) এসব ছবি নির্মাণ করেছেন। যেন জাতি গঠনের একটি অংশ হিসেবেই এসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। ভারতে সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, আদুর গোপল কৃষ্ণ, গিরীশ কাসারাভালি এবং ভারতীয় নবতরঙ্গের আরো অন্য নির্মাতা মিলে জাতীয় চলচ্চিত্রের ভারতীয় অধ্যায়টি রচনা করেছেন। মনে রাখা ভালো, জাতীয় চলচ্চিত্র কোনো সংগঠিত, পরিকল্পিত আন্দোলন নয়; কিন্তু একটি জাতির যৌথ চেতনা, বিশ্বাস, আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে ধারণ করে নির্মিত চলচ্চিত্রের ভান্ডার।

আমরা জানি যে, এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়, এমন বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেই আবদুল জব্বার খান নেমে পড়েছিলেন ‘মুখ ও মুখোশ’ নির্মাণের কাজে। সেই থেকেই তো শুরু।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়নের প্রক্রিয়াটি সরল হয় নি। ১৯৪৭-এ এক ‘ফলস ডন’ বা মিথ্যা প্রভাতের সূচনা এই প্রক্রিয়াকে জটিল এবং অনেক বেশি রক্তক্ষয়ী করেছিল। অন্য আর সকল কিছুর মতো এদেশের চলচ্চিত্রকেও তার খেসারত দিতে হয়েছিল। বিশেষ করে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক শক্তিতে ও দক্ষতায় দুর্বল এক ঔপনিবেশিকের শাসন ও শোষণের ফলে সকল কিছুতেই এদেশের শুরুটা পিছিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এসবের মাঝেই চলচ্চিত্রচর্চার আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়েছিল উপনিবেশ-বিরোধী এক স্পিরিট থেকে। আমরা জানি যে, এদেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়, এমন বক্তব্যকে চ্যালেঞ্জ করেই আবদুল জব্বার খান নেমে পড়েছিলেন মুখ ও মুখোশ নির্মাণের কাজে। সেই থেকেই তো শুরু।

কিন্তু তারও আগে, অনেক অনেক আগে, এদেশেরই মানুষ হীরালাল সেন যে উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন সে কথা কিন্তু মনে রাখা সহজ হয় নি। ইতিহাস বিস্মৃতির ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়েছিল। গত শতকের সত্তর দশকের শেষ ভাগের আগে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় নি।

কিন্তু তারও আগে, অনেক অনেক আগে, এদেশেরই মানুষ হীরালাল সেন যে উপমহাদেশে প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন সে কথা কিন্তু মনে রাখা সহজ হয় নি। ইতিহাস বিস্মৃতির ঔপনিবেশিক প্রক্রিয়াটি কার্যকর হয়েছিল। গত শতকের সত্তর দশকের শেষ ভাগের আগে সেদিকে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় নি। তারপর থেকে ব্যক্তি-গবেষক, সাংবাদিক, উৎসাহী চলচ্চিত্রসংসদ কর্মীরা হীরালাল সেনকে পুনরাবিষ্কার করে ইতিহাস পুনর্লিখনের সুযোগ করে দিয়েছিলেন। তারপরও ঔপনিবেশিক হ্যাঙওভার চলেছে, বিস্মৃতির আড়াল থেকে চলচ্চিত্রের এই জনককে তাঁর যোগ্য আসনে বসাতে সময় কম লাগে নি; এখনও সে এক চলমান প্রক্রিয়াই।

পথিকৃৎ চিত্রগ্রাহক হীরালাল সেন (১৮৬৬-১৯১৭)

শুরুর সময়ের আর যে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা তা হলো, ওই জগাখিচুড়ি ঔপনিবেশিক আমলেই প্রথম যে সরকার এদেশের মানুষের ভোটে ক্ষমতায় এসেছিল, সেই যুক্তফ্রন্টের সময় ঢাকায় এফডিসি স্থাপিত হয়েছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখনকার শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী হিসেবে এ-বিষয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন। জাতীয় চলচ্চিত্রের আলোচনায় এটি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এদেশে চলচ্চিত্রনির্মাণ কার্যক্রমটি চালু হওয়াটা জাতীয় চলচ্চিত্রের একটি আবশ্যিক পূর্বশর্ত।

পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে ষাটের মাঝামাঝি পর্যন্ত নির্মিত আসিয়া, ধারাপাত, সূর্যস্নান, কখনও আসেনি, কাঁচের দেয়াল, নদী ও নারী এসব ছবিকে কিভাবে দেখব আমরা? নানা সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিল্প-সংবেদী এসব প্রচেষ্টা সম্ভবত বিউপনিবেশায়নের প্রচেষ্টার এক ঝাঁক প্রাকসূচক। কিন্তু এসব ছবি বাণিজ্যিকভাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল। প্রধান কারণ লাহোর ও বোম্বাইয়ের উর্দু ও হিন্দি ছবি দর্শকের যে-রুচি তৈরি করে রেখেছিল তা এইসব ছবি উপভোগের উপযোগী ছিল না। অন্য কোনো ধরনের পৃষ্ঠপোষকতাও এরা লাভ করে নি। একথা মনে করি যে, উর্দু ছবির বাণিজ্যিক দাপট না থাকলে এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পণ্য ভোগের এক বিচিত্র, বিষম আধুনিকায়নের প্রকল্প জারি না থাকলে এইসব ছবির ধারাবাহিকতাতেই ক্রমশ এমন ছবি নির্মিত হতো যা চলচ্চিত্রের বিউপনিবেশায়নের আলোচনায় প্রাসঙ্গিক বিবেচিত হতে পারত। কিন্তু সেটা ঘটা সম্ভব হয় নি।

একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনা এই যে, প্রথমে যেসব ছবি এদেশের জীবন ও প্রকৃতির এক সৎ ও শিল্পিত রূপ নির্মাণের চেষ্টা করেছিল তাদের অন্যতম উর্দু ছবি জাগো হুয়া সাভেরা। মানিক বন্দোপাধ্যায়েরপদ্মা নদীর মাঝি সে-ছবির মূল প্রেরণা। নির্মাতা এ জে কারদার। এদেশের চলচ্চিত্রনির্মাতা এবং প্রযোজকেরা টিকে থাকার জন্যে মরিয়া হয়ে প্রথমে স্বকীয়তা বিসর্জন দিতে উদ্যোগী হয়েছিলেন এবং তারপর অতীতমুখী হয়ে পড়েছিলেন। প্রথম বিষয়টি ছিল উর্দু ছবি নির্মাণের প্রচেষ্টা। অন্তত সে-সময়ের বাস্তবতায় উর্দু ছবি নির্মাণ জাতীয় চলচ্চিত্র প্রচেষ্টার সহগামী ছিল—এমন বলা যায় না। কিন্তু দ্বিতীয় যে উদ্যোগ—জনপ্রিয় লোককাহিনিভিত্তিক বা লোককাহিনির আদলে কাহিনি বানিয়ে নিয়ে যাত্রা ঢঙের চলচ্চিত্র নির্মাণ—সেটিও জাতীয় চলচ্চিত্রের ধারণায় লাগসই নয়।

১৯৬৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সালাউদ্দিন পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘রূপবান’

কারণ, এসব ছবিতে লোককাহিনির কোনো সমকালীন ব্যাখ্যা বা ডিকন্সট্রাকশন উপস্থাপিত হয় নি। আঙ্গিকের দিক থেকেও যাত্রার ফর্মটিকে ভেঙে নতুন কিছু করার চেষ্টা লক্ষ করি না। ফলে এই অন্তর্মুখী প্রবণতা এবং অতীতচারিতা আসলে ঔপনিবেশিক মানসের ডেসপারেশন বা টিকে থাকার প্রয়াস হিসাবেই গণ্য হবে। তবে উল্লেখ না করা অন্যায় হবে যে, এসব ছবি, রূপবান থেকে শুরু করে, এদেশের প্রান্তিক মানুষকে প্রথমবারের মতো চলচ্চিত্রের অভিজ্ঞতায় যুক্ত করেছিল। গবেষকরা বলছেন যে, মহকুমা সদর পর্যন্ত তখন প্রেক্ষাগৃহ স্থাপিত হয়েছিল এবং নিম্নবর্গের মানুষ প্রায় একই সাথে বিদ্যুতায়ন ও চলচ্চিত্রের সাথে পরিচিত হয়েছিল। আর লাহোরের ঔপনিবেশিক পুঁজির সাথে লড়াই করে টিকে গিয়েছিল বাঙালি পুঁজি। সেদিক থেকে ব্যাপকতর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিউপিনবেশায়নের প্রক্রিয়ায় এই ঘটনা গুরুত্ব বহন করে বটে।

ষাটের দশকের দ্বিতীয়ার্ধে শুরু হয়েছিল নগরবাসী মধ্যবিত্ত জীবনের আবহকে কেন্দ্র করে রোমান্টিক মেলোড্রামার সময়। টেলিভিশন, জাপানি গাড়ি, হাউস বিল্ডিঙের ঋণ, সেভেন-আপ, ফান্টা, টেডি প্যান্ট, ব্রিল ক্রিম—এসব আধুনিকায়নের উপকরণে তখন সবে রমরমা হয়ে উঠছে উকিল, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, অধ্যাপক আর সরকারি অফিসারদের জীবন। এই সমকালীন জীবনকে নিয়ে রূপকথাময় চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছিল অনেক—সুন্দর মুখ, মিষ্টি সুর, মান-অভিমানে টসটসে সংলাপ, ভুল বোঝাবুঝির দিনরাত্রি এবং মধুর সমাপ্তি। উপনিবেশের পণ্যবাহিত আধুনিকায়নের এক ধরনের মহিমায়ন ঘটেছিল এসব ছবিতে। বিদ্যমান জীবনবিষয়ক কোনো জরুরি সংলাপ সেখানে সৃষ্টি হয় নি। আরো যা গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, সে-সময় রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়নের তথা জাতীয়তাবাদী জাগরণের যে-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, এই মধবিত্তেরই একাংশ যার নেতৃত্বে ছিল, তা আদৌ প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে নি এসব ছবিতে।

মধ্য-ষাট থেকে শুরু হয় এদেশে নির্মিত চলচ্চিত্রের বাণিজ্যিক সাফল্য লাভ। তাতে উর্দু ছবি নির্মাণ সেভাবে ভূমিকা রাখে নি। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে বেশির ভাগ উর্দু ছবিই ভালো ব্যবসা করে নি। তবে লোককাহিনির আদলে নির্মিত ছবি এবং তারপর নাগরিক মধ্যবিত্তকে নিয়ে মেলোড্রামা ভালো বাজার পায়। অন্য কারণের সাথে একটি প্রধান ব্যাপার হলো এসময় ভারত থেকে ছবি আসা বন্ধ হয়ে যায়। কলকাতার বাংলা ছবির প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হয় না ঢাকার ছবিকে। এই প্রটেকশন বা পরিরক্ষণ স্বাধীনতার পরেও অব্যাহত থাকে।  

ষাটের দশকে এদেশে যে-ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ রাজনৈতিক আবহ তার উত্তাপ প্রায় পড়েই নি ঢাকার চলচ্চিত্রে। যে-জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটছিল তখন তাকে ব্যবহার করে আর্থিক সাফল্যের কথা ভাবেন কোনো কোনো চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী। এরই ফলশ্রুতি হিসেবে নবাব সিরাজউদ্দৌলা’র মতো চলচ্চিত্র নির্মিত হয় এবং প্রভূত ব্যবসায়িক সাফল্য অর্জন করে।

বাংলা চলচ্চিত্রের এক প্রধান মাইলফলক ‘জীবন থেকে নেওয়া’

জহির রায়হান আসলে সময়ের দাবিরই সমান হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়, রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়ন যখন ক্লাইমেক্সে পৌঁছুচ্ছে এবং তা যখন ভীষণ রক্তাক্ত এক যুদ্ধ তখন তার ‘স্টপ জেনোসাইড’ সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল।

সাতচল্লিশ পরবর্তী ঔপনিবেশিক আমলের চলচ্চিত্র জাতীয় চলচ্চিত্রের ধারণায় সেভাবে সংযুক্ত হতে পারে নি। এর অন্যথা হলো জীবন থেকে নেয়া-য় পৌঁছে। এই জনপদের মানুষের জীবনে তখন গণ অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতা সদ্যপ্রাপ্ত। এই সময় জহির রায়হান উত্তরিত হলেন। তিনি কাঁচের দেয়াল থেকে সঙ্গম আর বাহানা হয়ে, বেহুলা-য় পৌঁছেছিলেন। অর্থাৎ, তার ছিল প্রাথমিক যুগের সৎ চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা। মরিয়া হয়ে গিয়েছিলেন উর্দু ছবি করতে। করেছিলেন লোকজ কাহিনিভিত্তিক ছবিও। এখন, এই ক্রান্তিকালে তিনি উপনিবেশককে চ্যালেঞ্জ করলেন—রূপকে এবং প্রামাণ্যধর্মিতায়। জীবন থেকে নেয়া উপনিবেশকালেই উপনিবেশকের রাজনৈতিক সমালোচনায় প্রবৃত্ত হয়েছিল। সে-ছবির নানা সীমাবদ্ধতা, বিশেষ করে মধ্যবিত্ত রোমান্টিক মেলোড্রামার অনেক চরিত্রই তার বজায় ছিল, তার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে জেন্ডার ইস্যুতেই আপত্তি উঠেছে; কিন্তু বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জাতীয় চলচ্চিত্রে উত্তরণের সংলাপে জীবন থেকে নেয়া এক প্রধান মাইলফলক।

জহির রায়হান পরিচালিত চলচ্চিত্র ’স্টপ জেনোসাইড’ -এর একটি দৃশ্য

জহির রায়হান আসলে সময়ের দাবিরই সমান হয়ে উঠেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময়, রাজনৈতিক বিউপনিবেশায়ন যখন ক্লাইমেক্সে পৌঁছুচ্ছে এবং তা যখন ভীষণ রক্তাক্ত এক যুদ্ধ তখন তার স্টপ জেনোসাইড সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। লক্ষ করি, সেই সংগ্রামে এই ছবি এক ইতিবাচক অনুঘটকের কাজ করেছিল এবং বলব, বিপ্লবী তৃতীয় চলচ্চিত্রের ধারণার এক সফল বাস্তবায়ন হয়েছিল এই চলচ্চিত্রে। সংগ্রামের সফলতার পরে নয়, সংগ্রাম চলাকালেরই ছবি স্টপ জেনোসাইড।  

পাকিস্তানি সময়ে নির্মিত ছবির একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৫৬ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত মোট ২০৬ টি চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। এর ভেতর বাংলা ছবি ১৫৮টি এবং উর্দু ছবি ৪৮টি। (কবির: ১৯৭৯, ৪৫)

আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৫৬ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত নির্মিত ছবি মধ্যে ৩৭ টি লোককাহিনিভিত্তিক ছবি, ১৪০ টি সামাজিক ছবি, ১৪ টি ফ্যান্টাসি ছবি, ২ টি থ্রিলার ছবি, ৬ টি কমেডি ছবি, ৬ টি ঐতিহাসিক ছবি এবং ১ টি শিশুতোষ ছবি নির্মিত হয়। (কাদের: ১৯৯৩, ২১৪)

মুক্তিযুদ্ধ এবং তারপর

আমরা আলমগীর কবিরের লেখা থেকে জানি যে, মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানের নেতৃত্বে তাঁরা কিছু পরিকল্পনা গ্রহণ করেছিলেন। এই পরিকল্পনায়, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে চলচ্চিত্রশিল্পকে সম্পূর্ণ জাতীয়করণের প্রস্তাব করা হয়েছিল। চলচ্চিত্রনির্মাণের সিদ্ধান্ত কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করা, অভিজ্ঞ এবং নতুন মেধাবী নির্মাতাদের দিয়ে ছবি নির্মাণ করানো এবং তাঁদের সরকারি বেতনের আওতায় রাখা, চলচ্চিত্র বিতরণ ও প্রদর্শন ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ জাতীয়করণ করা এসবই ছিল এই পরিকল্পনার অংশ। ১৯৭২-এর ৩০শে জানুয়ারি জহির রায়হানের অন্তর্ধানের পর সেসব পরিকল্পনা নিয়ে আর কোনো অগ্রগতি হয় নি।

যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণ শুরু হয়েছিল এবং প্রায় অর্ধ শতাব্দী পরও এই প্রবণতা অব্যাহত রয়েছে। এই রচনার পরিধির মধ্যে আমরা কোনো চলচ্চিত্রের শিল্পমূল্য বিচারের প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করতে চাই না। সাধারণভাবে বলা যায়, মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র জাতীয় ইতিহাসের দিকে আমাদের দৃষ্টিকে নিবদ্ধ রেখেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের যে বহু ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ, মুক্তিবিষয়ক মানুষের যে বিচিত্র স্বপ্ন এবং আকাঙক্ষা; সর্বোপরি সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগের যে মহাকাব্যিক বিস্তৃতি তার অতি সামান্যই এখন পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে ধারণ করা গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র ১৯৭১-এর স্বাধীনতার দিকে দৃষ্টিক্ষেপ করে চলেছে বটে, কিন্তু সেই দৃষ্টিক্ষেপ অর্ধ শতাব্দীর পথচলায় যে বৈদগ্ধ অর্জন করার কথা ছিল তা তার হয়ে ওঠে নি। এই বৈদগ্ধের অভাব জাতীয় চলচ্চিত্রের সফল উত্তরণের ক্ষেত্রে একটি বড় অন্তরায়। বিশেষ করে সফল জাতীয় চলচ্চিত্রের নির্মিতিতে আমরা এমন স্থানিক অভিব্যক্তি আশা করি যা বিশ্ব পরিমণ্ডলে বিকল্প বিশ্বায়নের ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করবে। এমন অভিব্যক্তি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবিতে হয় নি বললেই চলে।

কিন্তু প্রশ্ন করা যেতে পারে, বাংলাদেশে জাতি-গঠনের প্রক্রিয়াটি কতখানি সর্বব্যাপী হয়েছিল, ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠান এবং মূল্যবোধগুলিকে প্রতিস্থাপনের পরিকল্পনা রাষ্ট্র কি গ্রহণ করেছিল? অথবা এসব সম্ভাব্য প্রকল্পের অংশীদার হিসেবে সংস্কৃতিকে কি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হয়েছিল? চলচ্চিত্র নিয়ে কি কোনো রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা ছিল? আমরা জানি যে, স্বাধীনতার পরই চলচ্চিত্র নিরঙ্কুশ সংরক্ষণের সুবিধা লাভ করেছিল। অথচ নির্মাণ এবং প্রদর্শন ক্ষেত্রে রাষ্ট্র কোনো ভূমিকা নিতে চায় নি। শিক্ষিত চলচ্চিত্রকর্মী তৈরির কোনো উদ্যোগ রাষ্ট্র গ্রহণ করে নি। সত্তর দশকের যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে সৎ দেশীয় পুঁজি প্রায় অনুপস্থিত ছিল। বরং কালো টাকা চলচ্চিত্রে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগকৃত হয়েছিল যার মালিকানা ছিল দুর্বৃত্ত শ্রেণির হাতে। তাদের নেতৃত্বে প্রধান চলচ্চিত্রসমূহ এক নেতিবাচক সাংস্কৃতিক পণ্যে পরিণত হয়েছিল। অথবা খুব জোর ঔপনিবেশিক যুগের রূপকথা আর মেলোড্রামার পুনরাবৃত্তি চলছিল। প্রথমে নকল ছবি, তারপর ভায়োলেন্স এবং কাটপিস অশ্লীলতা; প্রযুক্তিগত ভয়ানক পশ্চাদপদতা—এভাবেই চলেছে প্রায় তিন দশক।

কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছবি

১৯৭৩ থেকে মধ্য আশির দশক পর্যন্ত আলমগীর কবির অন্তত পাঁচটি এমন ছবি নির্মাণ করেছিলেন যেগুলি জাতীয় জীবনের নানা জরুরি প্রসঙ্গকে নিয়ে কাজ করতে সচেষ্ট হয়েছিল, সমকালীন জীবনের বিকল্পের সম্ভাবনাকে নিরীক্ষা করে দেখতে চেয়েছিল। ধীরে বহে মেঘনা, সূর্যকন্যা, সীমানা পেরিয়ে, রূপালী সৈকতে এবং মোহনা বাংলাদেশের জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রকল্পে প্রথম ধারাবাহিক প্রচেষ্টা।

সত্তর ও আশির দশকে লাঠিয়াল, চরিত্রহীন, সারেং বউ, গোলাপী এখন ট্রেনে, কলমিলতা, সূর্য গ্রহণ, এখনই সময়, সূর্য দীঘল বাড়ী, ঘুড্ডি, সুরুজ মিয়া প্রভৃতি ছবি বিভিন্ন মাত্রায় বিদ্যমান জীবনবিষয়ক জরুরি সংলাপে যুক্ত হয়েছে। চলচ্চিত্র এসব ছবির মধ্য দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের একটি নিজস্ব অভিব্যক্তি মাধ্যম হয়ে উঠতে চেয়েছে। তাদের দৃষ্টিক্ষেপের ভিন্নতা এবং আগ্রহের বৈচিত্র্য জাতীয় চলচ্চিত্রের সূচক হিসেবে কাজ করেছে।

সত্তর ও আশির দশকে নির্মিত এসব ছবি দর্শকপ্রিয়তায় প্রান্তিক ছিল। অনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় চলচ্চিত্র-সংস্কৃতির যে-প্রবণতা তাতে এটি প্রায় প্রত্যাশিতই। কিন্তু যে-বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তা হচ্ছে এই যে, জাতীয় চলচ্চিত্রের কোনো প্রকল্প জাতি গঠনের প্রকল্পের অধ্যায় হিসেবে এ-সময় বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জারি ছিল না। ফলে, বিকল্প সাংস্কৃতিক পণ্য হিসেবে এসব ছবির প্রচার এবং প্রসারের সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যায় নি। জনমনে এসব ছবির গুরুত্ব ও মহত্ত্ব সম্পর্কে কোনো বিশেষ ধারণার সৃষ্টি হয় নি। অন্যদিকে, এসব ছবির  কোনোটিই আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটি শিল্প-আইকন হয়ে ওঠে নি, যার খ্যাতি স্থানীয়ভাবে তার বিষয়ে আগ্রহের নবায়ন ঘটাবে। এভাবে জাতীয় চলচ্চিত্রের প্রজেক্ট চলচ্চিত্রে তার আঁতুর অবস্থা পার করতে পারে নি।

ঋত্বিক কুমার ঘটক পরিচালিত চলচ্চিত্র
তিতাস একটি নদীর নাম-এর পোস্টার

এমনকি মহান ঋত্বিক ঘটক যে নির্মাণ করেছিলেন তিতাস একটি নদীর নাম তা নানা জটিলতায় গুরুত্ব পায় নি। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছিল রাজেন তরফদারের পালঙ্ক ছবির ক্ষেত্রেও। এসব ছবির বাণিজ্যিক সাফল্য নিয়ে আমরা কথা বলছি না, বরং, নতুন রাষ্ট্রে নতুন সমাজ এবং সংস্কৃতি নির্মাণে এসব শিল্পবস্তুর গুরুত্ব উপলব্ধিতে ব্যর্থতা ছিল। 

সত্তর দশকেরই এক সময় ভারতীয় ছবির নকল তৈরির হিড়িক পড়ে গেল। ১৯৭৭-এর জানুয়ারি পর্যন্ত একটি পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে। যুদ্ধের ছবি: ৫টি, নকল নয় এমন প্রচলিত ধারার ছবি: ২৫টি, নকল ছবি: ১২৫ টি, অফ-বিট ছবি: ৮ টি (কবির: ১৯৭৯, ৫৭)

বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন

আশির দশকের একটি সময় থেকে চলচ্চিত্র কর্মকাণ্ডে একটি সমান্তরাল প্রবণতা হিসেবে যুক্ত হয়েছিল বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলন। এ-সময়ের তরুণেরা আশির দশকের মাঝামাঝি যখন সংগঠিত হয়েছিলেন বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের বাতাবরণে তখনই তাঁদের ঘোষণাপত্রে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণের কথা বলেছিলেন। প্রথম প্রজন্মের শর্ট ফিল্ম ফোরামের কর্মীরা যেসব ছবি গত তিন দশকে করেছেন, কাহিনি এবং প্রামাণ্যচিত্র, তাদের বেশিরভাগই মুক্তিযুদ্ধ, স্থানিক নৃতত্ত্ব, লোকজ বিশ্বাস, নতুন নগরের সংবেদ এসব বিষয়ে আগ্রহী হয়েছেন। তারা চলচ্চিত্রকে একটি প্রতিযোগিতামূলক পণ্যের বদলে একটি স্থানিক সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তি হিসেবে গ্রহণ করেছেন। উপনিবেশের ইতিহাস এবং উত্তরাধিকার, জাতি-রাষ্ট্র নির্মাণের সম্ভাবনা ও সমস্যা, আত্মপরিচয়ের সংকট, ঐতিহ্যের পুনরাবিষ্কার—এভাবেই চলেছে তাঁদের চলচ্চিত্রনির্মাণের প্রধান প্রবণতা। অন্তত প্রথম তিন দশকে তাঁদের উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিগুলোর বিষয়বৈচিত্র্যের দিকে নজর দেওয়া যেতে পারে:

শেকড় অন্বেষণলালসালু, মাটির ময়না, চিত্রানদীর পারে
আরবান অ্যানথ্রপলজিএকটি গলির আত্মকাহিনী, আমাদের ছেলেরা
শিল্পের নিরীক্ষাচতুর্থ মাত্রা, ইতি সালমা
ইতিহাসের বিকল্প পাঠশিলালিপি, ইতিহাস কন্যা
সমাজ ও জনপদকৃষ্ণনগর, অয়ি যমুনা
বিপন্ন প্রতিবেশবিল ডাকাতিয়া
স্বদেশ ও ঐতিহ্যচিন পাখি, আদম সুরত
এক্টিভিজমকালিঘর, গ্রহণকাল, রোকেয়া
মানবিক অস্তিত্ববাদচাকা, কীর্তনখোলা
সামাজিক বৈষম্যদুখাই
মধ্যবিত্ততাআবর্তন
রাজনীতির রোমান্টিকায়নহুলিয়া
মুক্তিযুদ্ধআগামী, মুক্তির গান, নদীর নাম মধুমতি

কিন্তু বেদের মেয়ে জোসনার এই সাফল্য প্রায় আকস্মিক এক ঘটনা। চলচ্চিত্রের প্রচলিত স্রোত ভায়োলেন্ট এবং অ্যাবুসিভ হয়ে ওঠে এবং দর্শক হারায়। আশির দশকের মাঝামাঝিই ভিডিওতে ঘরে বসে ছবি দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বেদের মেয়ে জোসনা এবং তারপর

১৯৯০-এর এক প্রধান ঘটনা বেদের মেয়ে জোসনা , ছবির পরিচালক তোজাম্মেল হক বকুল। ছবিটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং ধারণা করা হয় এই ছবি পূর্বের যে-কোনো ছবির তুলনায় বেশি ব্যবসাসফল হয়। লোককাহিনির কিছু উপাত্তকে অবলম্বন করে এই ছবির কাহিনি বিন্যাস করা হয়েছে।

তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত ‘বেদের মেয়ে জোস্‌না’ চলচ্চিত্রের পোস্টার

কিন্তু বেদের মেয়ে জোস্‌না এই সাফল্য প্রায় আকস্মিক এক ঘটনা। চলচ্চিত্রের প্রচলিত স্রোত ভায়োলেন্ট এবং অ্যাবুসিভ হয়ে ওঠে এবং দর্শক হারায়। আশির দশকের মাঝামাঝিই ভিডিওতে ঘরে বসে ছবি দেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়। ভিডিও ক্যাসেটে মুম্বাইয়ের হিন্দি ছবি এবং হলিউডের ছবি দেখার সুযোগ তৈরি হয়। প্রায় তিন দশক ধরে বাংলাদেশের ছবি নিজের বাজারে যে নিশ্ছিদ্র পরিরক্ষণ পাচ্ছিল তা ভেঙে পড়ল। মানুষ এদেশে নির্মিত ছবির নিম্নমানের কাহিনি, দুর্বল প্রযুক্তি এবং দরিদ্র চলচ্চিত্র ভাষাকে সম্পূর্ণ প্রত্যাখান করে। চলচ্চিত্র শিল্পে ধস নামে।

   এ-পর্যায়ে গত শতকের পঞ্চাশের দশক থেকে শেষ দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের পথচলার একটি ছক তুলে ধরা যেতে পারে:

সময়কালরাজনৈতিক আবহসামাজিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোচলচ্চিত্র ইতিহাস
পঞ্চাশ দশকের প্রথম ভাগআন্দোলন, ভোটযুদ্ধ, বাম আদর্শে অনুপ্রাণিত আবহকৃষিনির্ভর অর্থনীতি এবং মফস্বলীয় নাগরিকতার সূচনা, ভাষাভিত্তিক আইডেন্টিটিতে আস্থার সূচনামুখ ও মুখোশ-এর মাধ্যমে স্থানীয় বাংলা চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু
পঞ্চাশ দশকের শেষ ভাগবাম রাজনীতির অব্যাহত প্রভাবসৎ নাগরিক মনস্কতার বিকাশ, আদর্শবাদি সংস্কৃতি চর্চাজীবনধর্মী সৎ চলচ্চিত্র, এ-প্রক্রিয়া ষাটের দশকে ক্ষীণ ধারা হিসেবে অব্যাহত
ষাটের দশক (প্রবণতা-১)সামরিক আইনআধা মফস্বলী ও গ্রামীণ পরিবেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণির ধীর বিকাশলাহোরের ছবির বিরুদ্ধে অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে লোককাহিনীর চলচ্চিত্রায়ন ও ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন, উর্দু ছবি নির্মাণের প্রবণতা
ষাটের দশক (প্রবণতা-২)বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ এবং গণঅভ্যুত্থানমধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং ক্ষমতায়নের সম্ভাবনামধ্যবিত্তের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ এবং ক্ষমতায়নের সম্ভাবনা
১৯৭১মুক্তিযুদ্ধপোড়ামাটি, গণহত্যা, উদ্বাস্তু জীবনস্টপ জেনোসাইড এবং যুদ্ধকালীন প্রামাণ্যচিত্র
সত্তর দশকব্যর্থ রাজনীতি, সামরিক শাসনের প্রত্যাবর্তন এবং ধর্মীয় মৌলবাদের নবজীবন লাভআইডেন্টিটি ক্রাইসিসের প্রত্যাবর্তন, মধ্যবিত্তের বদলে আরবান দুর্বৃত্ত শ্রেণির ক্ষমতায়নভায়োলেন্ট ও এবুসিভ চলচ্চিত্রের সূচনা, উল্টো স্রোতে আলমগীর কবিরের ছবিগুলি, সরকারি অনুদানে ছবি তৈরির প্রচেষ্টা, সূর্য দীঘল বাড়ীর নির্মাণ
আশির দশকসামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ গণআন্দোলন, মধ্যবিত্ত রাজনীতির দোদুল্যমানতায় মৌলবাদের শক্তি অর্জনআত্মপরিচয়ের ক্ষেত্রে দ্বিখণ্ডিত জাতিসত্তা, অনুন্নত পুঁজিবাদি সমাজের বিকাশলুটেরা পুঁজির দখলে চলচ্চিত্র, আলমগীর কবিরের অব্যাহত উজান যাত্রা, মধ্যবিত্তের প্রেক্ষাগৃহ বর্জন, ভিডিও সংস্কৃতির বিকাশ, বিকল্প চলচ্চিত্রের যাত্রা শুরু
নব্বই দশকএলিট শ্রেণির দ্বিদলীয় গণতন্ত্রস্থানীয় দুর্বৃত্ত পুঁজি এবং আন্তর্জাতিক একচেটিয়া পুঁজির প্রবল প্রভাব, তথাকথিত বিশ্বায়নের প্রভাবে বিনষ্ট দেশবোধআকাশ সংস্কৃতির প্রভাবে চলচ্চিত্র ব্যবসায় মন্দা, নেতিবাচক প্রবণতাসমূহ অব্যাহত, বিকল্প চলচ্চিত্রের বিভিন্ন সম্ভাবনার উন্মোচন

ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্রের তিন ধারা

এরপরই আসে ডিজিটাল প্রযুক্তি। চলচ্চিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শনীর ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিকায়ণ ঘটে। তার সাথে যুক্ত হয় ইন্টারনেটের যোগাযোগ বিপ্লব। এসব মিলে বিশ্বব্যাপী এক নতুন চলচ্চিত্রের সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ পরে হলেও এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে শুরু করে।

এই শতকের প্রথম দশকের মাঝামাঝি থেকে চলচ্চিত্রে তিনটি ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে। আমরা তাদের প্রথম সিনেমা, দ্বিতীয় সিনেমা এবং তৃতীয় সিনেমা নামে আখ্যায়িত করব।

প্রথম সিনেমা বাংলাদেশের প্রচলিত বাণিজ্যিক ঘরানার ছবি। এসব ছবি ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে প্রবেশ করেছে বটে, কিন্তু বিষয় ও প্রকাশভঙ্গির কারিগরি দিক থেকে গ্রাম্যতা এদের ছেড়ে যায় নি। প্রায় ছয় দশক ধরে এদেশের প্রধান প্রচলিত ধারার ছবিতে যে চলচ্চিত্রায়িত যাত্রার মেজাজটি বজায় আছে এসব ছবি তাদের উত্তরসূরি। নব্বই-এর দশকের কাটপিসের যুগে যে ছবি ডুবতে বসেছিল, সেই ছবিই নিজেকে পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে; মূল্যবোধে, রুচিতে যেটুকু পার্থক্য ঘটেছে সে সামান্যই এবং অস্তিত্বের প্রয়োজনে।

দ্বিতীয় সিনেমার আবির্ভাব ঘটেছে অ্যাড ফিল্ম, প্যাকেজ নাটক, স্যাটেলাইট টেলিভিশন, টেলিফিল্ম এসব সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ধারাবাহিকতায়। এসব ছবির নির্মাতারা বেশিরভাগ এসেছেন বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র বা টেলিভিশনের নাটক নির্মাণের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে। তাদের এক ধরনের চলচ্চিত্রিক স্মার্টনেস আছে, তারা চলচ্চিত্রের সমসায়িক কারিগরি বিষয় নিয়ে উত্তেজিত এবং তারা দক্ষ চলচ্চিত্র কারিগরদের নিয়ে কাজ করেন। তারা আশা করেন যে, নতুন প্রজন্ম এবং যোগাযোগ প্রযুক্তির কল্যাণে চলচ্চিত্রসহ তাবৎ পণ্যের বিশ্ববাজারের সাথে মোটামুটি পরিচিত জনগোষ্ঠী তাদের নির্মিত সিনেমা দেখবেন এবং আমোদিত হবেন। দ্বিতীয় ধারার চলচ্চিত্রের জাতীয় চলচ্চিত্র হয়ে ওঠার পথে বড়ো সমস্যা তাদের অ-স্থানিক ভঙ্গি এবং কখনও অতিরিক্ত বাণিজ্যচিন্তা।

তৃতীয় ধারাটি ষাটের প্রথম পর্যায়ের সিরিয়াস ছবি, সত্তরের আলমগীর কবিরের চেষ্টাগুলি, চলচ্চিত্রসংসদ আন্দোলনের অগ্রজদের কাজ (সূর্য দীঘল বাড়ী, ঘুড্ডি, এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী) এবং বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনের ছবিগুলোর সাথে একসূত্রে গাঁথা। এসব ছবি চলচ্চিত্রকে মূলত একটি অভিব্যক্তি মাধ্যম হিসেবে দেখতে চাইছে। এক ধরনের স্থানিক অভিব্যক্তি নির্মাণের চেষ্টা করছে। এই ধারায় প্রচুর প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হচ্ছে যাদের দৃষ্টিক্ষেপ এদেশের মানুষের জীবনের শক্তিমান চলচ্চিত্রায়ন করছে। এই ধারায় নিরীক্ষামূলক কাজও হচ্ছে। এসব ছবির প্রধান সমস্যা হচ্ছে এদের প্রান্তিকতা। বিদ্যমান বাস্তবতায় এসব ছবি দেশের দর্শকের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।  

একটি বিষয় পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন। দ্বিতীয় চলচ্চিত্রের কোনো নির্মাতা তৃতীয় চলচ্চিত্রের মতো কিছু নির্মাণ করতে পারবেন না, প্রথম চলচ্চিত্রের নির্মাতার হাতে দ্বিতীয় ধারার কোনো চলচ্চিত্র সৃষ্টি হতে পারে না—এমন মতামত প্রকাশ করছি না। আমাদের আগ্রহ চলচ্চিত্রের বিভিন্ন রকমের দিকে। কোনো নির্মাতাকে আমরা লেবেল এঁটে দিচ্ছি না। বরং আমরা আগ্রহের সাথে লক্ষ করছি যে সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞাপন চিত্রের জগৎ থেকে আসা কোনো কোনো নির্মাতা যে-কোনো অর্থেই উন্নত মানের তৃতীয় চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন।

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান যে-অবয়ব আমরা দেখতে পাচ্ছি তাতে ওপরে চিহ্নিত কোনো নির্দিষ্ট ধারায় জাতীয় চলচ্চিত্রের বিকাশের সম্ভাবনা প্রবল নয়। আমাদের বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র, অর্থাৎ প্রথম ও দ্বিতীয় চলচ্চিত্র এমন আকার এবং মানে পৌঁছুবে না যে তা এমনকি তার নিজস্ব স্পেসেও আন্তর্জাতিক বা আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সিনেমাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। আবার চলচ্চিত্রের উৎকর্ষের বিবেচনায় সেটি পারা বা না পারা কোনো পরিমাত্রা নয়। অন্যদিকে, এখন যেভাবে তৃতীয় চলচ্চিত্র নির্মিত এবং প্রদর্শিত হচ্ছে বা হচ্ছে না, তাতে করে এই সিনেমা একটি চূড়ান্ত প্রান্তিক ইতিবাচকতামাত্র হয়ে থাকতে বাধ্য। এই প্রান্তিকতা কোনোভাবেই জাতীয় চলচ্চিত্রের রূপ নেবে না; উৎকৃষ্ট চলচ্চিত্রের যে-ধারাবাহিকতার ওপর আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি তা এরকম নিয়তির হাতে ছেড়ে দেয়া একটি প্রক্রিয়ায় অর্জিত হবে না।

ডিজিটাল প্রযুক্তির দ্বিমুখী সম্ভাবনা

এ-পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আমরা কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করতে পারি। প্রথমত, রাষ্ট্র সম্প্রতি যেসব সুযোগ সৃষ্টি করছে চলচ্চিত্র-শিক্ষা, আর্কাইভাল, নির্মাণ অনুদান এবং ডিজিটাল প্রেক্ষাপণের—এসব সুবিধাকে ব্যবহার করে জাতীয় চলচ্চিত্র বিষয়ক কোনো সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা যায় কি না। প্রশ্ন উঠবে, এই সমন্বয়ের কাজটি কে করবে? রাষ্ট্র যদি এ-বিষয়ে সচেতন রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দ্বারা পরিচালিত না হয় তাহলে এই সমন্বয় কঠিন হতে বাধ্য। আর এই সমন্বয়ের অভাবে এসব সুবিধার ফল ভোগ করে নব্য উপনিবেশবাদী সাংস্কৃতিক চিন্তা এবং পণ্য নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

দ্বিতীয়ত, ডিজিটাল প্রযুক্তি চলচ্চিত্রনির্মাণের প্রক্রিয়ায় যে গণতন্ত্রায়ণ ঘটিয়েছে তার সম্ভাবনা ব্যাপক। যারা স্থানিক নিরীক্ষায় কিংবা রাজনৈতিক চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী তাদের জন্যে কাজটি আগের মতো কঠিন নয়। এমনকি এই প্রযুক্তির সুবিধায় এরকম চলচ্চিত্রের প্রচার ও প্রদর্শনও এখন অপেক্ষাকৃত সহজ। সুতরাং, ডিজিটাল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে নতুন, উত্তর-উপনিবেশী চলচ্চিত্র পাওয়ার সম্ভাবনা সুপ্রচুর। উল্টোদিকে লক্ষ করা যাবে যে, এই প্রযুক্তির হাত ধরে বিশ্ব-পুঁজি-কেন্দ্রের সাংস্কৃতিক পণ্যসমূহ অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে প্রান্তিক দুনিয়ার অধিবাসীদের বস্তু ও মনোজগতের দখল নিচ্ছে। চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে এই আগ্রাসন অতি প্রবল। এই দুই বিপরীত শক্তির টানাপড়েনে শেষ পর্যন্ত কে জিতবে তা অনেকখানিই কিন্তু নির্ভর করে নানা ধরনের সক্রিয়তার ওপর। শেষ পর্যন্ত বিউপনিবেশায়ন এবং তার ভেতর দিয়ে জাতীয় চলচ্চিত্রে পৌঁছানো, একটি আদর্শিক সংগ্রাম বটেই।

তৃতীয়ত, অর্থনীতিতে এক ধরনের গতি সঞ্চারের সাথে সাথে চলচ্চিত্রে অপ্রচলিত সূত্র থেকে বিনিয়োগ ঘটছে। এদের চলচ্চিত্রের ব্যবসায় সাফল্য অর্জন ছাড়াও নানা প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য এজেন্ডা রয়েছে। আমাদের চলচ্চিত্রে গত দেড় দশকে যে এক ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে তার একটি কারণ এই অপ্রচলিত বিনিয়োগ। অনেক নতুন নির্মাতা এসব বিনিয়োগের হাত ধরে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন। যারা শুরু করেছিলেন বিকল্প চলচ্চিত্র আন্দোলনে, তারাও এই নতুন পুঁজির সহায়তায় ছবি করছেন। আমাদের সনাতন চলচ্চিত্র থেকে তাদের চিন্তার, রুচির ও অভিব্যক্তির পার্থক্যকে চেনা যাচ্ছে। নতুন পুঁজি এবং নতুন নির্মাতারা যদি বিনোদন নির্মাণে নব্যঔপনিবেশিক উপাদান এবং আঙ্গিকের নকলনবিশি করার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে, এমনকি, তাদের বাণিজ্যিক ভবিষ্যৎও খুব উজ্জ্বল নয়। অন্যদিকে, তারা যদি এই নতুন পুঁজিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হন তাহলে নিজস্ব অভিব্যক্তি নির্মাণের দরজা খুলে যেতে পারে। তা এমনকি চলচ্চিত্র-সাম্রাজ্যবাদের যে-আঞ্চলিক আগ্রাসন তার বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রতিরোধও নির্মাণ করতে পারে।

আছেন পণ্ডিতেরা, যারা মনে করেন যে তারা জানেন, প্রান্তের মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বাস্তবতাকে! তাদের এই জানা কিন্তু বহুলাংশেই দুশ বছর আগে শুরু হওয়া ওরিয়েন্টালিস্ট জ্ঞানচর্চারই সম্প্রসারণ এবং সমসাময়িকীকরণ মাত্র।

চতুর্থত, যোগাযোগ বৃদ্ধির সাথে সাথে চলচ্চিত্রের অর্থায়নে বিদেশি তহবিল, অনুদান ইত্যাদির সম্ভাবনা বেড়েছে। নির্মাতারা তাদের সম্ভাব্য চলচ্চিত্র নিয়ে সম্ভাব্য বিনিয়োগের সাথে যুক্ত হতে চাইছেন। প্রয়োজনে সশরীরে উপস্থিত হয়ে নিজের স্ক্রিপ্ট বিষয়ে পিচিং করছেন। ফেস্টিভ্যাল পরিচালক এবং কিউরেটররা অনেক ক্ষেত্রে এসব তহবিলকে নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই বাস্তবতায়, এক নতুন ধরনের ওরিয়েন্টালিজমের জন্ম হওয়ার আশংকা আছে। আমাদের চলচ্চিত্রে এমন অভিব্যক্তি নির্মিত হওয়ার সম্ভাবনা আছে, বাস্তবতার এমন ব্যাখ্যা নির্মিত হওয়ার সুযোগ আছে যা আসলে তাঁরা দেখতে বা দেখাতে চান। এই তাঁরার মধ্যে আছেন পশ্চিমের বাজার নিয়ন্তারা, যাঁরা জানেন তাঁদের দর্শক এসব প্রাক্তন উপনিবেশের কেমন অভিব্যক্তি দেখতে চায়, অথবা জটিল ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় কোন অভিব্যক্তি এখন তাদের বিশেষ কোনো স্বার্থকে রক্ষা করবে। আছেন পণ্ডিতেরা, যারা মনে করেন যে তারা জানেন, প্রান্তের মানুষের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও বাস্তবতাকে! তাদের এই জানা কিন্তু বহুলাংশেই দুশ বছর আগে শুরু হওয়া ওরিয়েন্টালিস্ট জ্ঞানচর্চারই সম্প্রসারণ এবং সমসাময়িকীকরণ মাত্র। এরকমটি হলে বহুরাষ্ট্রীয় এসব তহবিল নব্যউপনিবেশবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে মাত্র।

একটি খোলা চুক্তির প্রয়োজনীয়তা

যে-জাতীয় চলচ্চিত্রকে চলচ্চিত্রের উৎকর্ষের প্রধান শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করছি তার জন্যে কিন্তু রাষ্ট্রের প্রাসঙ্গিক অংশীদারদের মধ্যে একধরনের চুক্তি প্রয়োজন। যে-চুক্তি অনুযায়ী দেশপ্রেমিক পুঁজি এবং রাষ্ট্র শিল্পচলচ্চিত্রে বিনিয়োগ করবে, রাষ্ট্র চলচ্চিত্র শিক্ষা এবং প্রদর্শন অবকাঠামোয় ব্যাপক বিনিয়োগ করবে এবং প্রাইভেট বিনিয়োগকে উৎসাহিত করবে, নির্মাতারা স্বাধীন অভিব্যক্তি নির্মাণে, বিশেষায়িত একটি স্বদেশী চলচ্চিত্র ভাষার সন্ধানে নিরত হবেন, প্রযুক্তির সর্বশেষ পরিবর্তনের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে নির্মাণ করবেন সমকালীন সিনেমা। সকলের লক্ষ্য থাকবে এই চলচ্চিত্রের ভেতর দিয়ে একটি সাংস্কৃতিক সংগ্রামকে ক্রমাগত পরিচালিত করা। এই সংগ্রাম দৃশ্যগত যে-সমতায়ন ও একশৈলিকতা, পণ্যের ক্ষুধা নির্মাণের নৃশংসতা তার বিরুদ্ধে পরিচালিত এক মহৎ প্রচেষ্টা। এই চুক্তি কীভাবে অর্জিত হবে, রাষ্ট্রের ভেতর কাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন ছাড়া এরকম চুক্তি আদৌ সম্ভব কি না, এসব প্রশ্ন ও তর্ক জরুরি। কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে অনিখুঁত রাষ্ট্র-কাঠামোর ভেতর থেকেই এ-ধরনের চুক্তি অর্জন এবং জাতীয় চলচ্চিত্রের বিকাশ সম্ভব হয়েছে। মূলত, আমাদের দেশে নানা ধরনের অর্থনৈতিক কার্যক্রম, জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, উদ্বৃত্ত পুঁজির সৃষ্টি, আমলাতন্ত্রের মধ্যে আলোকিত চিন্তার মানুষের অনুপ্রবেশ, প্রযুক্তির প্যারাডাইম পরিবর্তন এবং রাজনৈতিক শক্তির কোনো কোনো অংশের মধ্যে কল্যাণ-রাষ্ট্র এবং জাতীয়তা-বিষয়ক নানা স্ববিরোধী ভাবালুতা এই সুযোগ সৃষ্টি করেছে। তর্কের খাতিরে বলা যায়, ভালো সিনেমার আন্দোলন আসলে এই চুক্তি অর্জনের চেষ্টাই করে আসছে আধা শতক ধরে। লেখা যায়, একটি বাতাবরণ এই চুক্তিটি নির্মাণের জন্যে স্থির লক্ষ্যে কাজ করে যেতে পারে। বস্তুত এটি কোনো কাগজে লিখিত দলিল নির্মাণ প্রচেষ্টা নয়, নির্দিষ্ট সংখ্যক দফার দাবি আদায়ের সংগ্রাম নয়, বরং, প্রায় বা মোটামুটি প্রস্তুত অথবা কয়েকটি বিরুদ্ধ স্রোতকে একটি বিস্তৃত অনুধাবনের মধ্যে প্রবেশ করানো, এবং ক্রমাগত সংলাপ, অর্জন এবং আবারও সংলাপের ভেতর দিয়ে যাত্রা।

এরকম ব্যাপকভিত্তিক বোঝাপড়ার ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এমন এক কালে প্রবেশ করতে পারে যখন আমরা বছরে অন্তত দশটি এমন ছবি নির্মাণ করব যাদের বিষয়ে আমাদের গর্ব করার সুযোগ থাকবে। এইসব চলচ্চিত্র আমাদের জাতীয় সংবেদকে ঋদ্ধ করবে বিষয় ও উপস্থাপনার সর্বাধিক বৈচিত্র্যের মধ্যে। এই সিনেমা এমন ইমেজ আইকন নির্মাণ করবে যার রাজনীতি আমরা সামষ্টিক অর্থে জাতীয়ভাবে অনুমোদন করি অথবা যা আমাদের মধ্যে একটি ব্যাপকভিত্তিক স্বাস্থ্যকর বিতর্কের জন্ম দেয়। এই সিনেমার ইমেজ স্পেস হবে আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের পরিচিত, কিন্তু উপস্থাপনার নৈপুণ্যে বিস্ময়করভাবে নতুন। এই সিনেমা নিয়ে আমরা গ্লোবাল আর্ট সিনেমার হাটে পসরা সাজাব। জাতীয় চলচ্চিত্র ত্রুটিহীন, মেধাহীন পুনরাবৃত্তি হবে না; আমরা কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার অধীনে চলচ্চিত্র কারখানা গড়ার কথা তুলছি না; আমরা আসলে এখন যাদের বিকল্প চলচ্চিত্রের নির্মাতা বলে জানি তাঁদের জন্যে জাতীয় পর্যায়ে স্পেস নির্মাণের কথা বলছি মাত্র। এই স্পেস নির্মাণে দেশপ্রেমিক জনগোষ্ঠীকে একত্রিত করার বা একটি সুশৃঙ্খল, মসৃণ কর্মচক্র সৃষ্টির সম্ভাবনার লক্ষ্যে কাজ করার কথা বলছি। এই চক্র চলচ্চিত্র-শিক্ষা থেকে নির্মিতি হয়ে প্রদর্শন পর্যন্ত মেধাবী চলচ্চিত্রনির্মাতার সাথে অবৈরী আচরণ করবে। সহজ কথায়, চলচ্চিত্র শিক্ষা হবে যুগোপযোগী এবং সে-শিক্ষায় শিল্পবোধ ও দক্ষতা অর্জনের সমন্বয় ঘটবে। সরকার এমন চলচ্চিত্র নির্মাণে এবং প্রদর্শনে সহায়তা করবে কারণ, একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের অধিবাসীরা যাতে দৃশ্যমানতা-বিষয়ক দূষণে আক্রান্ত না হন, যাতে শিশুরা দৃশ্য-জিঘাংসার শিকার না হয়, যাতে দেশের মানুষের শিল্পসংবেদ মহৎ উচ্চতা অর্জন করে তা নিশ্চিত করতে চাইবেন। দেশপ্রেমিক ভালো পুঁজি চলচ্চিত্র নিয়ে গর্বিত হতে চাইবে, দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের শিল্প-চলচ্চিত্রের খ্যাতির গর্বিত অংশীদার হতে চাইবে। সেন্সর নামক বিষয়টি হয়তো থেকেই যাবে, কিন্তু সে একটি চলচ্চিত্র একটি প্রান্তিক নৃগোষ্ঠীর ভাষায় নির্মিত হয়েছে এমন যুক্তিতে ছবিটিকে গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইবে না। দেশের মানুষ এরকম একটি বিষয়ে গর্ব-সচেতন হবে যে, আমরা ভালো ছবি করি, আন্তর্জাতিক মানে।

সেই সিনেমা সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনকে সূচিত করতে পারে কি না, সে ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু অনেক মৌলিক চিন্তা, এগিয়ে থাকা আইডিয়া এই চলচ্চিত্রের হাত ধরে প্রবহমাণ থাকতে পারে; সময়ে হয়ে উঠতে পারে প্রবল ও প্রধান।

মিডিয়া আর্ট ও র‍্যাডিক্যাল সিনেমা

র‍্যাডিক্যাল সিনেমার যুদ্ধটি অবশ্য ভিন্ন। যাঁরা ওপরে উল্লিখিত প্রক্রিয়ায় আস্থা রাখতে পারবেন না তাঁদের জন্যে খোলা পথটি র‍্যাডিক্যাল সিনেমার পথ। আমরা ধরে নেব তাঁদের আদর্শিক অবস্থান অনেক সুদৃঢ় এবং লড়াইয়ের জন্যে তাঁদের মানসিক ক্ষমতা আছে। তাঁরা লাতিন আমেরিকার তৃতীয় চলচ্চিত্রের মতো সংগঠিত রাজনৈতিক অবস্থান গ্রহণ করতে পারেন। অন্যদিকে, আজকের প্রযুক্তি ব্যক্তিগত চলচ্চিত্রকে একটি সম্ভাব্য প্রতিপাদ্যে পরিণত করেছে। ব্যক্তিগত নির্মাণ, ব্যক্তিগত দর্শন (Viewing)—এভাবে অগ্রসর হওয়ার সুযোগ আছে তাঁদের যাঁরা এরকম ঢিলে একটি চুক্তির খোলসে নানা ধরনের আপসের পথে পথ হাঁটতে রাজি নন এবং যাঁদের চলচ্চিত্রে উপস্থাপনের মতো বিপ্লবী আইডিয়া আছে। সেই সিনেমা সমাজ বা রাষ্ট্রকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তনকে সূচিত করতে পারে কি না, সে ভিন্ন বিতর্ক। কিন্তু অনেক মৌলিক চিন্তা, এগিয়ে থাকা আইডিয়া এই চলচ্চিত্রের হাত ধরে প্রবহমাণ থাকতে পারে; সময়ে হয়ে উঠতে পারে প্রবল ও প্রধান। অথবা র‍্যাডিকাল সিনেমা চলচ্চিত্রবিষয়ক ব্যক্তিগত নিরীক্ষাও হতে পারে যা এখনই জাতীয় চলচ্চিত্রের মতো একটি সামাজিক বাতাবরণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারছে না। এরকম অভিব্যক্তির আধার হিসেবে আমরা মিডিয়া আর্টকেও দেখতে পারি। কারণ, সেখানে কাজের স্বাধীনতা অনেক; চলচ্চিত্রের ভাষা ব্যবহারে এবং কোনো কর্তৃপক্ষীয় চোখ রাঙানি ছাড়াই সম্ভাব্য দর্শকের কাছে পৌঁছার ক্ষেত্রে। মিডিয়া আর্টে আমরা তো এরই মধ্যে এমন অভিব্যক্তির উপস্থাপনা দেখেছি যা সেন্সরের বাধা ডিঙিয়ে প্রথাগত চলচ্চিত্রে অসম্ভব। অবশ্য মিডিয়া আর্ট র‍্যাডিকাল পথে হাঁটবে, না কি আন্তর্জাতিক শিল্পসাম্রাজ্যবাদের তল্পি বহন করবে, সেটা একটি খোলা প্রকল্প।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিকল্প চলচ্চিত্র। বিকল্পের প্রয়োজন তো ফুরিয়ে যাবার নয়। বরং, জাতীয় চলচ্চিত্র যদি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিমান হয়ে ওঠে আমাদের দেশে তখন সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার জন্যেই বিকল্প সিনেমার প্রয়োজন পড়বে।

নতুন বিকল্প সিনেমা

কিন্তু, এটা ভাবতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি যে, মিডিয়া আর্টের যে আপাত বিপ্লবী আবহ তাতে করে তাকে আমরা শিল্প-সম্ভাবনার এই দুই চরম প্রান্তেই দেখতে থাকব। ভবিষ্যৎবাণীর মতো শোনাবে, কিন্তু সকল প্রবণতা এমনটি নির্দেশ করে যে, ক্রমশ ব্যক্তিগত চলচ্চিত্র এবং মিডিয়া আর্ট একাকার হয়ে যাবে এবং চলচ্চিত্র এক নতুন প্রশাখায় প্রবাহিত হবে। বিশেষ করে ইন্টারঅ্যাকটিভ সিনেমা, ননলিনিয়ার ডকুমেন্টারি বা ডাটাবেজ ডকুমেন্টারির মতো নব্য প্রযুক্তির প্রায়োগিক ধারণাগুলি এরকম সম্ভাবনারই ইঙ্গিত দেয়। এমন এক অভিব্যক্তির আধার রচিত হবে যা হয়তো অষ্টম শিল্প হয়ে উঠবে। কিন্তু সে কেবল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের ব্যাপার নয়, সারা পৃথিবীর চলমান ছবিবিষয়ক বয়ানেরই এক নতুন অধ্যায়। আমরা কেবল আশা করতে পারি যে, সেই নতুন অভিব্যক্তি-মাধ্যম এদেশের শিল্পের উৎকর্ষের আরেক বাহন হবে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে বিকল্প চলচ্চিত্র। বিকল্পের প্রয়োজন তো ফুরিয়ে যাবার নয়। বরং, জাতীয় চলচ্চিত্র যদি একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে শক্তিমান হয়ে ওঠে আমাদের দেশে তখন সেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার জন্যেই বিকল্প সিনেমার প্রয়োজন পড়বে। সে-বিকল্পের অভাবে জাতীয় সিনেমার আইডিয়া একটি ডগমায় পরিণত হবে। তার পরিণতি আমরা কিন্তু ইতিহাসের পাতায় দেখেছি। কে জানে, হয়তো, মিডিয়ার হাত ধরে র‍্যাডিকাল সিনেমা সেই বিকল্প প্রকল্পের বাহন হবে!

আপাতত শেষ কথা

চেষ্টা করেছি বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস পরিক্রমণের ভেতর দিয়ে আমাদের জাতীয় চলচ্চিত্রের সম্ভাবনাকে খতিয়ে দেখতে এবং কতিপয় প্রস্তাব সামনে নিয়ে আসতে। আমি মানি যে আমার প্রস্তাবসমূহ কোনো স্থায়ী স্বতঃসিদ্ধ নয়। বরং, সময়ের সাথে নতুন বাস্তবতা তৈরি হবে এবং জাতীয় চলচ্চিত্রের মতো একটি অবস্থায় উপনীত হতে আমাদের চলচ্চিত্রকে সেই বাস্তবতার চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করার জন্যে নতুন কৌশল নিতে হবে।

টীকা নির্দেশ:

কবির, আলমগীর: ১৯৭৯। ফিল্ম ইন বাংলাদেশ। বাংলা একাডেমী। ঢাকা। পৃ: ৪৫

কবির, আলমগীর: ১৯৭৯। ফিল্ম ইন বাংলাদেশ। বাংলা একাডেমী। ঢাকা। পৃ: ৫৭

কাদের, মির্জা তারেকুল, ১৯৯৩। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রশিল্প। বাংলা একাডেমী। ঢাকা। পৃ: ২১৪

কান, অ্যানেট, ওয়েস্টেল, গাই: ২০২০। এ ডিকশনারি অব ফিল্ম স্টাডিস। অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।

শিবকুমার, এস: ২০১৩। http://humanitiesunderground.org/all-the-shared-experiences-of-the-lived-world-ii/ প্রবেশ ১০ জুলাই ২০১৮।

শুলৎজ-এঙ্গলার, ফ্রাঙ্ক: ২০০৭। “Border Patrols: Postcolonialism and the Topography of Medernity.” Postcolonial (Dis) Affections, Editors: Walter Gobel and Sasika Schabio. Trier: Wissenschaftlicher Trier, pg 37-39.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে