তিনা মোদোত্তি: বিপ্লব ও শিল্পের জন্য উৎসর্গীকৃত জীবন

0
332

তিনা মোদোত্তির মতো যুগন্ধর শিল্পীর আবির্ভাব সচরাচর বেশি দেখা যায় না। ইতালির এক প্রত্যন্ত অঞ্চলে আবির্ভূত এই শিল্পী ও রাজনীতিক ইউরোপ, আমেরিকা, ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাসে স্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছেন। যাপন করেছিলেন এক বর্ণাঢ্য ও দুঃসাহসিক জীবন। আলোকচিত্রের ইতিহাসে তিনা মোদোত্তি এক উজ্জ্বল নাম। আলোছায়া আর কম্পোজিশনের মুন্সিয়ানায় তাঁর আলোকচিত্র আজও তাবৎ অনুসন্ধিৎসু আলোকচিত্রপ্রেমীকে বিস্ময়াভিভূত করে। কমিউনিজমের তুঙ্গস্পর্শীকালে তিনার রাজনৈতিক সত্তা ধাবিত হয়েছিল এমন এক স্বপ্ন ও সম্ভাবনার দিকে যেখানে সমতা ও কল্যাণ ভিত্তিক রাষ্ট্র স্থাপিত হবে, শোষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে প্রলেতারিয়েত শ্রেণির মুক্তি ঘটবে। তাঁর শিল্পীমন ও রাজনৈতিক সত্তা দুটোর মধ্যে বিরোধ ও দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়নি এমন বলা যাবে না, তবে দুটোকেই বেশ আন্তরিকতা ও দক্ষতার সাথে মানিয়ে নিয়েছিলেন দীর্ঘদিন, এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুটোর মধ্যে বিরোধ নয় বরং ঐক্যের মেলবন্ধনের প্রচেষ্টা পরিলক্ষিত হয়েছে। আলোকচিত্রের বিষয় নির্বাচনেও এই কথার সত্যতা পাওয়া যায়।।

স্বল্প পরিসরে তিনা মোদোত্তির শৈল্পিক মন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তাঁর পারিবারিক পরিচিতি, বেড়ে ওঠা এবং জীবন-সংগ্রাম ইত্যাদি সম্পর্কে জানার জন্য বাঙলাভাষী পাঠকদের জন্য মনে হয় না আর কোনো বই আছে, অন্তত আমার জানামতে নেই।

তিনা মোদোত্তি ( ১৮৯৬-১৯৪২)

তিনা মোদোত্তি শুধু কমিউনিজম এবং আলোকচিত্রের সাথে যুক্ত ছিলেন না, থিয়েটার ও চলচ্চিত্রের মতো মাধ্যমেও কাজ করেছেন। তাঁর গানের গলাও নজর কেড়েছিল অনেকের। জীবন ছিল তীব্র সংগ্রামমুখর। মাত্র বারো বছর বয়সে পরিবারের আর্থিক দুর্দশা ঘোচাতে উইভিং মিলে কাজ করতে হয়েছিল যে-কিশোরীকে তাঁর পরবর্তী জীবন যে আয়েশে কাটবে না সেই অনুমানও ভুল ছিল না, এবং হয়েছেও তাই। এক জায়াগায় থিতু হয়ে থাকতে পারেননি বেশিদিন। দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে—কখনো রাজনৈতিক কারণে, কখনো জীবিকা নির্বাহের আশায়। জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সময়গুলো কাটিয়েছিলেন মেক্সিকোতে। আমেরিকা, স্পেন, জার্মানি, অস্ট্রিয়া ও রাশিয়াতে দিনাতিপাত করেছেন বিভিন্ন পরিস্থিতিতে। অনুবাদের কাজ করেছেন, করেছেন সম্পাদনার কাজ। পেশাদার আলোকচিত্রী হিসেবেও জীবিকা নির্বাহ করতে চেয়েছিলেন। হতে চেয়েছিলেন সংবাদকর্মীও। গুপ্তচর হিসেবেও কাজ করেছেন দলের জন্য। জেল খেটেছিলেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। পরিচিতজনদের বিশ্বাসঘাতকতা জীবনকে বিষাদে ভরে দিয়েছিল। ভালোবাসা-প্রেম-বিয়ে ইত্যাদিতে তাঁর জীবন বেশ টালমাটাল ছিল বলা যায়। প্রেমে পড়েছিলেন বারবার। একাধিক প্রেমিক এসেছিল জীবনে। সমসাময়িক অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিতি ও সখ্য ছিল। মেক্সিকোর রাজনৈতিক ইতিহাসেও তিনা মোদোত্তি আজও এক অবিস্মরণীয় নাম।

এল মাশেতে পত্রিকা এবং মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টির সদর দপ্তর

নানান উত্থান-পতন, হরিষ-বিষাদের মধ্যে মাত্র ছেচল্লিশ বছরের আয়ুষ্কাল পেয়েছেন। জন্ম ১৮৯৬, উদিন, ইতালিতে। মৃত্যু ১৯৪২ সালের জানুয়ারি মাসে। মেক্সিকো সিটি, মেক্সিকোতে। এবং যথারীতি তাঁর এই মৃত্যুকে স্বাভাবিক বলে চালিয়ে দেয়া হলেও এটা যে ঠাণ্ডা মাথার হত্যাকাণ্ড সে বিষয়েও জোর মত চালু রয়েছে। যাই হোক, এটি আজও এক অমীমাংসিত বিষয় হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।

১৯২৮ সালে তিনা মোদোত্তির তোলা বিখ্যাত আলোকচিত্র ‘উইম্যান উইথ ফ্ল্যাগ’

বাংলা ভাষায় তিনা মোদোত্তিকে নিয়ে রচিত বই বিশেষ নেই বললেই চলে। সমকালে তিনা মোদোত্তির বিশেষ পরিচিতি থাকলেও তাঁর মৃত্যু-পরবর্তী সময়ে তা অনেকটাই বিস্মৃতির গহ্বরে তলিয়ে যায়। এর সাথে অনেক ধরনের রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ জড়িত ছিল। তদুপরি তিনার মৃত্যু-পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী সময়কালে বিভিন্ন ধরনের অপপ্রচার ও কুৎসা রটানো হয়েছিল। রাজনৈতিক প্ররোচনা ও তথাকথিত সামাজিক মূল্যবোধের পরিপ্রেক্ষিতে তিনার মতো প্রতিভাবান আলোকচিত্রী ও রাজনৈতিক কর্মীর যথার্থ মূল্যায়ন হয়েছিল বলা যাবে না। আশার কথা, আশির দশক থেকে তিনার নাম আবার পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছে। নতুন করে পুনর্মূল্যায়ন হচ্ছে তাঁর আলোকচিত্রগুলোর, তাঁর রাজনৈতিক জীবন নিয়ে অনেকে নতুন করে গবেষণা করছেন। তিনাকে নতুন করে নতুনরূপে আবিষ্কার করছেন কেউ কেউ।

১৯২৮ সালের শ্রমিক সমাবেশের র‍্যালিতে দিয়েগো রিভেরাসহ পার্টিসভ্যগণ

মাহমুদ আলম সৈকত তিনা মোদোত্তির শিল্প, রাজনীতি ও জীবনীকে বাংলায় দুই মলাটের মধ্যে প্রকাশ করে বাংলাভাষী সাধারণ পাঠকের অশেষ উপকার করেছেন। লরেন হ্যামেরি ফেরাজের চিত্রকর্মের আলোকে করা প্রচ্ছদে বেশ নান্দনিক ও আকর্ষণীয় হয়েছে বইটি। বইয়ের বাঁধাই, মুদ্রণ সবকিছুতেই যত্নের ছাপ পরিলক্ষিত হয়। প্রচুর আলোকচিত্রের সমাবেশ, প্রতিটি অধ্যায়ের মনকাড়া শিরোনাম পাঠককে মুগ্ধ করবে। লেখকের ভাষাশৈলী, শব্দচয়নে পারঙ্গমতা, বর্ণনার কুশলতা লক্ষণীয়। প্রতিটি অধ্যায় শেষে পরের অধ্যায় পাঠের জন্য উৎসুক হবে পাঠকের মন।  

স্বল্প পরিসরে তিনা মোদোত্তির শৈল্পিক মন, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও তাঁর পারিবারিক পরিচিতি, বেড়ে ওঠা এবং জীবন-সংগ্রাম ইত্যাদি সম্পর্কে জানার জন্য বাঙলাভাষী পাঠকদের জন্য মনে হয় না আর কোনো বই আছে, অন্তত আমার জানামতে নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে লেখক ও প্রকাশক ধন্যবাদ প্রাপ্য এই ধরনের একটি ব্যতিক্রমী বই পাঠকের হাতে তুলে দেয়ার জন্য।

টেলিফোন ওয়্যারস, ১৯২৫ সালে তোলা তিনার আরেকটি বিখ্যাত আলোকচিত্র

বইটিতে মুদ্রণত্রুটি নেই বললেই চলে। বইয়ে লেখকের সৃজনশীলতা ও মননশীলতার চমৎকার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। তথ্যসূত্রের যে তালিকাটি বইয়ের শেষে দিয়েছেন সেভাবে না দিয়ে ফুটনোট আকারে প্রতি পৃষ্ঠায় তথ্যসূত্র দেয়া থাকলে তাতে পাঠক ও গবেষকরা বেশি উপকৃত হতেন। আলোকচিত্রগুলোর বর্ণনাও বইয়ের শেষে এক সাথে দেয়াতে বারবার পৃষ্ঠা উল্টিয়ে তথ্য মেলানোর কাজটি কখনো কখনো ধৈর্যচ্যুতি ঘটাতে পারে বলে মনে করি। প্রতিবর্ণীকরণে কিছু প্রমাদ ঘটেছে বলে মনে হয়েছে। বিশেষ করে স্প্যানীয় বাক্যের উচ্চারণ লেখাটা যথার্থ হয় নি। যেমন: ‘আস্তা মানাস’ (পৃ ১৪), ‘আস্তা লিগো’ (পৃ ১৫) যথাক্রমে আস্তা মানিয়ানা (hasta mañana) ও আস্তা লুয়েগো (hasta luego) হবে মনে হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন স্প্যানীয় নাম ও শব্দের উচ্চারণ ইংরেজির মতো উচ্চারণে লেখায় পাঠকদের সেগুলোর মর্মার্থ বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। আশা করি লেখক পরবর্তী সংস্করণে এই বিষয়গুলো আমলে নিবেন।

বাংলা ভাষায় তিনা মোদোত্তিকে নিয়ে এই ধরনের অসামান্য বইয়ের সার্বিক সাফল্য ও প্রচার কামনা করি। 

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে