হাসপাতাল কাণ্ডের মহাকাব্যিক আখ্যান

0
366

দৃশ্যগুলো এমন নয় যে এর জন্য ওঁতপেতে থাকতে হয়, কিংবা অনেক দিন অপেক্ষার পর এমন একটা ছবির দেখা মেলে, অথবা কোন দৈব দুর্বিপাক মানে সড়ক দুর্ঘটনা, খাদ্যে বিষক্রিয়া, নতুন ভাইরাসের আবির্ভাব কিছুই না। আমরা এমন এক দেশে এমন এক ব্যবস্থার মধ্যে থাকি তাতে হাসপাতাল আমাদের নিয়তি, যেতেই হবে। কেউ ঘুরতে বা বেড়াতে যায় না, সবাই যায় ঠেকায় পড়ে, এক মাথা দুশ্চিন্তা নিয়ে ছবির কথা ভাবতে পারে না, কি রোগী কি স্বজন কি ডাক্তার!

ডা. ইব্রাহীম ইকবালের ছবিগ্রন্থ AAMAR HOSPITAL INSIDE THE OTHER WORLD-এর প্রচ্ছদ

আশা নিরাশার এক অদ্ভুৎ যুদ্ধক্ষেত্র , হাসি কান্নার অপূর্ব মিশেল। এডমিটেড কিংবা ডিসচার্জ, ফ্লোর কিংবা শেয়ারিং বেড, হেডবক্স কিংবা নেবুলাইজার নিয়ে কাড়াকাড়ি, দাদু কিংবা মাসিকে গুঁজে দেয়া ২০ টাকার নোট, হৃদরোগ কিংবা প্রসূতি বিভাগের বাইরে উৎকণ্ঠিত স্বজনের মুখ, আইসিইউ কিংবা অপারেশন থিয়েটারের সামনে তসবিগোণা ভয়ার্ত মানুষের মুখ, অথবা ১৬ ঘন্টা ডিউটি সেরে ক্লান্ত চিকিৎসকের ঘরে ফেরা… এইসব হাজারো কথায় ভর্তি হাসপাতালের ওয়ার্ড কেবিন করিডোরগুলো। কার সময়-ধৈর্য্য আছে ক্যামেরা দিয়ে এই সব মানুষের ছবি তোলা? হ্যাঁ আছে যারা সংবাদ সংগ্রহে যান তাদের অবশ্যই আছে- সেটা খুবই কম সময়ের জন্য। নান্দনিক বোধ নিয়ে এইসব বৃত্তান্ত তুলে আনার চেষ্টা করেছেন আলোকচিত্রী ডা. ইব্রাহীম ইকবাল। পেশায় ডাক্তার। মনে হতে পারে এইকাজের জন্য তাঁকে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি । তবে সেটা একরৈখিক ভাবনা হয়ে যাবে। কেননা তিনি এই হাসপাতালের কর্মজীবী কেউ নন।

হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে অসুস্থ মাতামহী, তাকে দেওয়া খাবার খাচ্ছে শিশু পৌত্র

ছবিগুলো তোলায় তিনি নান্দনিকতার পাশাপাশি তথ্য আদানেও বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। অপরিষ্কার দেয়ালের আঁকিবুকি, অপরিচ্ছন্ন ফ্লোর কিংবা বেডে রুগী, স্যালাইন, নিডল, সুঁই, গাদাগাদি বেড, নার্স রুম, হ্যান্ডকাপ বাঁধা বিপন্ন কয়েদি রোগী ইত্যাদির চিত্র এমনভাবে তুলেছেন সেগুলো নান্দনিকতার পাশাপাশি জার্নালিজম ক্যাটাগরির ছবিতে রূপ নিয়েছে। আবার সমগ্র ছবি মিলে যখন একটা স্টোরি দাঁড়িয়েছে তখন সেটা ডকুমেন্টারি… এমনই ফটোগ্রাফির নানান বিভাগ উপবিভাগে ফেলা কঠিন কিছুই না। তবে দিন শেষে ছবিটা আপনাকে কতটুকু স্পর্শ করেছে সেটা আসল কথা।

হাসপাতালের বেডে সদ্য মা-হারা অকালজাত শিশু এবং তার মাতামহী

আমার হাসপাতাল একটি মহাকাব্যিক গ্রন্থ। বিষয় নির্বাচন, গ্রন্থের আকৃতি, ছবি সংখ্যা সর্বোপরি ছবিতে গল্প বলার টেকনিক সবকিছু মিলেই এর ব্যাপ্তি। বইয়ের ২২৮-২৩৩ এই ছয় পৃষ্ঠা জুড়ে ৩টি ছবি। দুটোর গল্পই কাছাকাছি, হয়তো সময়ের ব্যবধান। ১ম ছবিতে দেখা যায় একটি প্রিম্যাচুউরড বেবি এক পাশে অন্য পাশে নিরুপায় এক বৃদ্ধা। সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছে শিশুটির মা। এ অবস্থায় বৃদ্ধা দাদি কী করবেন? অস্পষ্ট করে দেখা যায় তার অসহায় মুখ। অন্যদিকে পরের পৃষ্ঠায় যেন গল্পটির আরেক অধ্যায়। সেখানেও এক মাতৃহীন শিশু খাবারের জন্য কাঁদছে, অসুস্থ দাদি চোখের ছানি অপারেশনে এসেছেন, শিশুটির কান্না যেন এক মৃত নারীর পাশে। দুটো ছবি আলাদা, চরিত্র আলাদা, কিন্তু একই গল্পের ভিন্ন অধ্যায় যেন! অকালপ্রজ শিশুটি কিছুটা বড় হল, আর অসহায় বৃদ্ধা হারাল চোখের আলো! পরের ছবিতে আরেক অনাথ শিশু কাঁদতে কাঁদতে খাচ্ছে। এখানেও এক অসহায় দাদি অদূরে বসা। এভাবেই হাসপাতালের বেডে বেডে রচিত আলাদা অথচ একই সূত্রে গাঁথা গল্প- যে গল্পের  শেষ নেই!

এই বইয়ের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল, নানা মানুষের নানান অনুভূতির মুখাবয়ব। প্রচলিত ভাষায় যাকে পোর্ট্রেট বলা হয় ছবিগুলো তাকেও উৎরে গেছে। কোন গ্ল্যামার কিংবা আর্ট নয় এ মুখাবয়বগুলোতে ধরা পড়েছে কেবল যন্ত্রণা – নৈরাশ্য কিংবা হাসপাতাল থেকে মুক্তির আনন্দ। তবে আনন্দের ভাগটা কম।  কাভারের ছবিতে অগ্নিদগ্ধ এক ব্যক্তির চোখ ছলছল পোর্ট্রেট কিংবা ২৯ পৃষ্ঠার ফিজিওথেরাপি দেয়া লোকটির তীক্ষ্ণ চোখ আমাদের চোখ ভেদ করে মনে জায়গা করে নেয়।

চক্ষু বিভাগে চিকিৎসাধীন মাতামহীর পাশে কান্নারত অনাথ শিশু

অজীব বস্তুতে প্রাণ সঞ্চারণ; যেন এক মহাকাব্যিক ব্যাপার স্যাপার। শুধু মানুষ কিংবা সামগ্রিক চিত্র বলতে যা বুঝায় এ গ্রন্থ তার থেকেও বেশি কিছু। যেসব ছবি সাধারণ আলোকচিত্রীরা এড়িয়ে যান অনায়াসে সেরকম ভিন্ন কিছু ছবির কথা শোনাই। হাসপাতালে শুধু মানুষ আর তাদের দুর্ভোগ নয় আছে কিছু নির্বাক সাক্ষী। শুধু চেয়ার, বেঞ্চ, রোগীবিহীন বেড ইত্যাদিও যে ছবিতে বক্তব্য আনতে পারে তা এ গ্রন্থ দেখলেই বুঝা যায়। আসবাবগুলোর পড়ে থাকা ভঙ্গি, বহু ব্যবহারে জীর্ণতা কিংবা ময়লাটে রঙ দেখলেই বুঝা হাসপাতাল অনুষঙ্গের কতকিছুই আমরা এড়িয়ে যাই। কিংবা একটি দেয়ালে একজন ডাক্তারের আধ ময়লা গাউন ঝুলছে আর দেয়ালে আরবি অক্ষরে স্রষ্টার বন্দনা… খুব সামান্য হয়েও যেন অনেক বড় গল্প শোনায় আমাদের। একই রেখায় সারি সারি স্যালাইন ঝুলছে, যেন মানুষকে সঞ্জীবনী সুধা বিলাচ্ছে। দুই পৃষ্ঠা জুড়ে গাছের মরাপাতা জমার দৃশ্য অপূর্ব এক শিল্পব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছে। জীর্ণ পাতার পরে কিশলয়ের জন্ম যেন মৃত্যু আর জীবনের প্রতীকী কথা আমাদের শোনায়।

ছবিগুলোকে সুন্দর প্রিন্টিং আর প্রকাশনাযোগ্য না করলে হয়তো আলোচনাটাও হত না। ওজন এবং সাইজে সম্ভবত এটি এদেশের অন্যতম ভারী একটি বই।  এজন্য বইটির কিউরেটর প্রদীপ আইচ ধন্যবাদ প্রাপ্য।  আর গুণগত মানের কথা তো আগেই বললাম। বইটির মূল্য চার হাজার টাকা যা চট্টগ্রাম মেডিক্যালের গরিব রোগীদের চিকিৎসা সেবায় ব্যয় হবে। কেননা ছবিগুলো সেখানেই তোলা। আমার হাসপাতাল বলে আলোকচিত্রী এইসব জরাগ্রস্থ রোগীদের পাশে এমনিতেই দাঁড়িয়ে গেছেন। আমার মনে হয় একটি গ্রন্থের অমরত্ব লাভের আর কিছু বাকি নেই!

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে