ব্রিটিশ নারীবাদী চলচ্চিত্র-তাত্ত্বিক ও চলচ্চিত্র নির্মাতা লরা মালভির জন্ম ১৯৪১ সালে। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ লন্ডনের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগে অধ্যাপক হিসাবে কর্মরত। ১৯৭৫ সালে প্রকাশিত “ভিজুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা” প্রবন্ধের জন্য ইনি সবচেয়ে বিখ্যাত। এই প্রবন্ধেই তিনি ‘পুংদৃষ্টি’ কথাটি উদ্ভাবন করেন এবং পুরুষ দর্শক ও তার দেখার সুখটাই যে চলচ্চিত্রের কেন্দ্রে থাকে, এই বৈসাদৃশ্যের স্বরূপ নিরূপণ করে একে তাত্ত্বিকভাবে মোকাবেলা করেন। তাঁর সময়ের ও পরবর্তী কালের অগণিত চলচ্চিত্র-নির্মাতা ও চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের চিন্তায় ও কাজে তাঁর চিন্তা ও বয়ানসমূহের গভীর প্রভাব লক্ষ করা যায়। নারীবাদী চলচ্চিত্র-পত্রিকা ‘এনাদার গেইজ’ লরা মারভির এ-সাক্ষাৎকারটি প্রকাশ করে ১৫ আগস্ট ২০১৮ সালে। মূল সাক্ষাৎকারের লিংক: https://www.anothergaze.com/suddenly-woman-spectator-conversation-interview-feminism-laura-mulvey/
এনাদার গেইজ: ফিল্মের তত্ত্বায়ন ও ফিল্ম বানানোর কাজে আপনি নিযুক্ত হওয়ার আগের যে-পর্বকে পরবর্তীকালে ‘সিনেখোর পর্ব’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছিল, আপনার জীবনের সেই সময়ের ব্যাপারে সামান্য কিছু বলে শুরু করতে পারেন?
লরা মালভি: আমার জন্ম ১৯৪১ সালে এবং যুদ্ধের পুরো সময়টা গ্রামাঞ্চলে ছিলাম বলে ছয় বছর বয়সে লন্ডনে ফিরে আসার আগ পর্যন্ত আমি কোনো ছবি দেখি নি । এই কারণে আমার প্রথম দেখা ছবিটার কথা পরিষ্কার মনে আছে। আমার মনে হয়, প্রথমটি ছিল নানুক অফ দা নর্থ [রবার্ট জে. ফ্ল্যায়ার্টি, ১৯২২] কারণ আমার বাবা ছিলেন কানাডার একেবারে উত্তর থেকে আসা মানুষ আর তিনি ইন্যুইট সংস্কৃতির ব্যাপারে আগ্রহী ছিলেন । আর যেসব ছবির কথা খুব স্পষ্টভাবে মনে আছে, পাঁচের দশকের গোড়ার দিক থেকে, সেগুলো হল মাইকেল পাওয়েল ও এমেরিক প্রেসবার্গের দা রেড শুজ আর জাঁ রেনোয়ার দা রিভার । মাঝে মধ্যে আমার মনে হয়, ছোটবেলায় বেশি সিনেমা না দেখার কারণে এই দুটো ছবি আমার চলচ্চিত্রীয় অজ্ঞানে বিশেষ দাগ কেটেছিল। আমার সত্যিকারের সিনেখোর জীবন শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পরে পিটার ওলেন সহ এক দল বন্ধুকে নিয়ে আমি যখন সিনেমা দেখতে যেতে শুরু করি। এই বন্ধুদের সবাই কাইয়ে দ্যু সিনেমা দ্বারা প্রভাবিত ছিল, ফলে এর দ্বারা হলিউডের, এবং ‘পলিতিক দেস অতর’-এর অংশরূপে কাইয়ে কর্তৃক বন্দনাকৃত পরিচালকগণের প্রতি প্রেমের এক অধ্যায় সূচিত হয়। এটি ছয়ের দশকে আমার বেশ কিছু সময় নিয়ে নেয়… সেই ছবিগুলো দেখতে যাওয়া, যেগুলো ঠিক সমকালীন নয় কিন্তু অচল হয়ে যায় নি। ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটার রেট্রস্পেক্টিভ দেখাতে শুরু করেছিল, আর আমরা যাচ্ছিলাম প্যারিসে, সিনেতেকে এবং বাম তীরের যে-কোনো সিনেমা হলে, এবং হলিউডি সিনেমার ব্যাপারে যতখানি সম্ভব জ্ঞান অর্জন করছিলাম।
এ. গে.: আর এই জ্ঞানকে আপনি কীসের স্বরূপ হিসাবে দেখেছিলেন? নাকি তা ছিল কেবলই সুখ?
ল মা: হ্যাঁ, সুখ। আমার মনে হয় সেটা ছিল সিনেমায় যাওয়ার বিশুদ্ধ আনন্দ। এখন যাকে ‘হলুদ পর্ব’ বলে আখ্যায়িত করা হয় সেই সময়ে কাইয়ে পড়ার কথা আমার মনে আছে, কিন্তু আদতে সেটা ছিল ফিল্মগুলোকে জড়ো করা আর কৃষ্টিটাকে আত্মস্থ করা, কোনো ভাবনাচিন্তা না করেই, অন্তত আমার দিক থেকে—শুধুই সুখের জন্য।
এ গে: তো এই সচেতনতার ব্যাপারটা কখন শুরু হলো? আরো আভাঁগার্দ সিনেমা দেখে, যেগুলোতে কৃৎকৌশলকে ইচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টিগ্রাহ্যরূপে দেখানো হয়?
ল মা: না, দর্শক হিসাবে আমার পরিবর্তনটা আসে হঠাৎ করে এবং সুনির্দিষ্টভাবে নারী আন্দোলনের প্রভাব থেকে, ফলে যে-ছবিগুলোকে আমি আগে ভালোবেসেছিলাম আর যে-ছবিগুলো আগে আমাকে নাড়া দিয়েছিল সেগুলোকে আমি আচানক ভিন্ন চোখে দেখতে শুরু করলাম। পর্দার ভিতরে, কাহিনির ভিতরে, প্রেক্ষাপটের ভিতরে, সিনেমার ভিতরে বুঁদ হওয়ার পরিবর্তে আমি হলাম বিরক্ত। আর একজন দেখনসুখী দর্শক তথা পুরুষ দর্শকের পরিবর্তে আচানক আমি নারী দর্শকে পরিণত হলাম, যে ঐ বুঁদ হওয়া চোখগুলো দিয়ে দেখার পরিবর্তে ফিল্মকে দেখতে শুরু করলো দূর থেকে ও জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।
এ গে: আপনার কি মনে হয় [আপনার তৎকালীন সঙ্গী] পিটার ওলেনেরও একই অনুভূতি হয়েছিল? নাকি মনে হয় এটা প্রায় প্রবৃত্তিজাত ছিল?
ল মা: ভালো প্রশ্ন। সিনেমার ব্যাপারে আমার চাইতে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক জটিলতাঋদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি ছিলো পিটারের, কেননা শিল্পকে সে সবসময়ই দেখে এসেছে আধুনিকতাবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে। দুইয়ের দশকের সোভিয়েত আভাঁগার্দ বিষয়ের আগ্রহকে ছয়ের দশকে পুনর্জাগ্রত করার কাজে পুরোধাদের একজন ছিল সে। একই সঙ্গে, আমার মনে হয় আভাঁগার্দ বিষয়ে আপনার প্রশ্নটা ঠিক, কেননা হলিউড তখন ম্লান হতে শুরু করেছিল। অতীতের মতো মহান সিনেমা এটা আর থাকে নি, আর সময় বদলে যাচ্ছিল। পিটার আভাঁগার্দীয় নতুন প্রবণতাগুলোতে প্রবলভাবে আটকা পড়ে এবং গদারের দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হতে শুরু করে। ছয়ের দশকের শেষাশেষিতে, সাতের দশকের শুরুতে, যখন আমি নারীবাদ দ্বারা প্রভাবিত হতে শুরু করেছি তখন লন্ডনে এমন নতুন ধরনের সব সিনেমা আবির্ভূত হতে শুরু করলো আগে যেগুলো কখনোই দেখা যায় নি। নব্য ব্রাজিলীয় সিনেমা, গদার, স্ত্রব-উইয়ে, আফ্রিকীয় সিনেমা: কাহিনীসূত্রকে ধরার, ভাববস্তুকে দৃশ্যায়িত করার এবং সিনেমাসইরূপে চিন্তা করার অনেক বেশি অভিনব সব উপায়।
সেখানেই আমরা, অন্যান্য তাত্ত্বিক লেখকদের মধ্যে, ফ্রয়েড পড়তে শুরু করি এবং এর অতি আশু প্রভাব পড়ে। তার মানে, মনে হলো যেন লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক যে–শব্দভান্ডার ও চিন্তা–পদ্ধতির প্রয়োজন আমাদের সবসময়ই ছিল, সেটা দিতে পারলেন ফ্রয়েড।
এ গে: আর নারী আন্দোলনের সঙ্গে আপনার প্রথম পরিচয় কীভাবে?
ল মা: সেটা ১৯৭০ সালে, লন্ডনে, বন্ধুদের মধ্যে যারা অক্সফোর্ডের রাস্কিন কলেজে ১৯৬৯ সালে অনুষ্ঠিত সর্বপ্রথম সভাটিতে উপস্থিত ছিল তাদের মাধ্যমে। এর পরে দ্রুতগতিতে নতুন নতুন দল গঠিত হতে শুরু করে, আর আমি ছিলাম এমন একটা দলের অন্তর্ভুক্ত যেটাকে নিয়ে অনেক আলোচনা ও কিছু লেখালিখি হয়েছে, যাকে হিস্ট্রি গ্রুপ অথবা ফেমিনিস্ট স্টাডিজ গ্রুপ বলা হতো। সেখানেই আমরা, অন্যান্য তাত্ত্বিক লেখকদের মধ্যে, ফ্রয়েড পড়তে শুরু করি এবং এর অতি আশু প্রভাব পড়ে। তার মানে, মনে হলো যেন লিঙ্গ ও যৌনতা বিষয়ক যে-শব্দভান্ডার ও চিন্তা-পদ্ধতির প্রয়োজন আমাদের সবসময়ই ছিল, সেটা দিতে পারলেন ফ্রয়েড। তাঁর সব কথার সঙ্গে একমত না হয়েও যেসব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গে আমরা আগ্রহী ছিলাম সেগুলোকে ভাষায় প্রকাশ করার উপায় আমরা খুঁজে পেলাম।
এ গে: ফ্রয়েড পড়ার পরামর্শে দলের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কী ছিল? উত্তেজনা নাকি সন্দেহ?
ল মা: দলের বেশিরভাগের কাছে অবশ্যই এটাকে অত্যন্ত উত্তেজনাকর সম্ভাবনা বলে মনে হয়েছিল, আর জুলিয়েট মিশেল তখন সাইকোএনালিসিস এন্ড ফেমিনিজম [১৯৭৪] বইটা সদ্য লিখেছেন, ফলে প্রভাব ও পরিবেশের বড় এক অংশ ছিল সেটা। আমি নিশ্চিত যে বেশ কিছু বিরূপ প্রতিক্রিয়াও হয়েছিল, কিন্তু যখন আরো নারীবাদী এ-নিয়ে লিখতে শুরু করলেন তখন আমাদের বড় অংশ এ-ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলো। আমার মনে হয়, নারীবাদ ফ্রয়েডকে সবসময়ই বিচারসাপেক্ষ দৃষ্টিতে দেখেছে। কিন্তু, নারীদের ব্যাপারে তাঁর অনেক ধারণাকে আমরা ভ্রান্ত মনে করতাম বলেই, এর মানে এটা দাঁড়ায় না যে তাঁর অজ্ঞান বিষয়ক ধারণা এবং ইডিপাস গূঢ়ৈষণার সূত্রায়ন রাজনৈতিকভাবে প্রাসঙ্গিক, আগ্রহব্যঞ্জক ও অব্যবহিত নয়।
এ গে: তবে কি ফ্রয়েড পড়ার পরেই দৃষ্টির সঙ্গে মনঃসমীক্ষণজাত চিন্তাকে যুক্ত করে আপনি সিনেমা দেখতে শুরু করলেন? নাকি সেটা ছিল নারী আন্দোলনের দ্বারা অনুঘটিত?
ল মা: এই দুটো একসঙ্গেই ঘটে। ফলে আপনি বলতে পারেন যে ১৯৭৫ সালে আমি যখন ‘ভিজুয়াল প্লেজার এন্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’ লিখি তখন হলিউড সিনেমাই ছিল এর প্রেক্ষাপট। কিন্তু, একই সঙ্গে, নারীবাদ, মনঃসমীক্ষণমূলক তত্ত্ব এবং, ক্রমবর্ধমানরূপে, আভাঁগার্দ নন্দনতত্ত্বকে স্বীকরণে আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আগেই ভীষণভাবে বদলে গিয়েছিল। যেমনটা বলছিলাম, পুরো পৃথিবীই পাল্টে যাচ্ছিল। হলিউড সমসময়ই প্রধানত দুটো কারণে অত্যন্ত কাজে আসত। প্রথমত, এ-ই সেই সিনেমা যাকে আমি এত ভালোভাবে চিনেছিলাম ও ভালোবেসেছিলাম। দ্বিতীয়ত, এই ধরনের বিশ্লেষণের জন্য এটা অত্যন্ত উপযুক্ত ছিল: ব্যাপারটা যেন এমন যে, হলিউড নিজেকে চমৎকার প্রেক্ষাপট হিসাবে তুলে ধরেছে এবং মনঃসমীক্ষণমূলক ও নারীবাদী বিচারিক বিশ্লেষণকে প্রায় আবাহন করে নিয়েছে। কাম-নজর; পুরুষ তারকা কুশীলব কর্তৃক তার নজরের লক্ষ্যবস্তুকে পর্যুদস্ত করার এবং গল্পের শক্তিমত্তা সৃষ্টির জায়গাটি; প্রদর্শবস্তু হিসাবে নারী—সমস্তই এমনভাবে ওখানে ছিল যা অন্য কোনো সিনেমায় ছিল না।
এ গে: আর আপনার ‘ভিজুয়াল প্লেজার এন্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’ লিখাটার শুরু কিভাবে?
ল মা: ঐ সময় পিটার আর আমি আমাদের ছেলে চ্যাড সহ যুক্তরাষ্ট্রে থাকি। নর্থওয়েস্টার্নে পিটার তার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়-চাকরি পেল, ফলে আমি খুব একটা কিছু করছিলাম না আর লিখার কাজটাকে আমার সহজ মনে হচ্ছিল না। এর আগে আমি ব্রিটিশ পপ আর্স্টিস্ট অ্যালেন জোন্সের সমালোচনা করে একটা লিখা লিখেছিলাম যেটা স্পেয়ার রিব-এ ছাপা হয়েছিল, আর পিটার ইউনিভার্সিটি অফ উইজকনসিনের ফরাসি বিভাগে একটা বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত হয়েছিল, আর কোনো ধরনের বিদ্যায়তনিক অবস্থান আমার না থাকা সত্ত্বেও, আমাকে কিছু একটা করার অনুরোধ না করাটা তাঁদের জন্য অস্বস্তিজনক হয় বলে, তাঁরা বললেন, “লরা, একটা প্রবন্ধমতো কিছু কি দিতে চান আপনি?” তো, সেই হলো প্রথম খসড়া, প্রথম কয়েকটা অনুচ্ছেদ, কিন্তু এতে করেই শুরুটা হয়ে গেল আর আমার মনে হয় ঐ একবারই, বা মাত্র কয়েকবারের মধ্যে একবার, আমি সত্যিকার অর্থে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কিছু লিখেছি।
এ গে: লিখার এই আতঙ্ক সম্পর্কে আরেকটু বলবেন?
ল মা: বিশ্ববিদ্যালয়-জীবনে আমার আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল, নিশ্চিত। মাঝেমধ্যে আমার মনে হতো, যেসব ভাববস্তু নিয়ে আমি চিন্তা করছি সেসবের ব্যাপারে ব্যক্তিগত দখল তৈরি করতে না পারার কারণেই এমনটা হতো, আর নারীবাদের দেখা পাওয়ার আগপর্যন্ত এমনটা হয় নি যে আমি আমার নিজের একটি দৃষ্টিকোণ, নিজের একটি হাতিয়ার, নিজের বলার মতো কিছু কথা পেয়েছি। আর, যা এটাকে আরো স্ফূর্তি দিয়েছিল সেটা হলো, সম্ভবত, এই ব্যাপার যে ওটা একান্ত আমার নয়; ওটা সামষ্টিক। একধরনের একটা তরঙ্গ, একটা আন্দোলন, একটা শক্তি থেকে এটা উঠে এসেছিল যা আবশ্যিকভাবে ব্যক্তিগত নয়। ফলে নিজের বক্তব্যকে একটা কাগজে সেঁটে দেওয়ার অনুভূতি ওতে ছিল না। বরং তা ছিল নিজের চাইতে অনেক বড় ও অনেক বেশি সাধারণ কোনো বিষয়ে কথা বলা।
এ গে: আর আপনার প্রথম ছবি পেনথেসিলিয়া বানানোর চিন্তাটাও তো আসে অমেরিকাতেই। কেবল দর্শক, যদিও তর্কশীল দর্শক, হয়ে থাকার পরিবর্তে সশরীরে ছবি বানানোর ব্যাপারে চিন্তা করতে শুরু করলেন কীভাবে?
ল মা: সিংহভাগই হয়েছিল কপালগুণে, কেননা যে-বিভাগে পিটার তখন কাজ করত সেটা ছিল চলচ্চিত্র প্রযোজনা বিভাগ এবং চলচ্চিত্র তত্ত্ব বিভাগ। পিটার তার বসকে বলেছিল যে সে আভাঁগার্দ বিষয়ের একটা কোর্স পড়াতে চায় আর তার বস তো মর্মাহত, কারণ সিনেমা বিষয়ক তাঁদের সামষ্টিক ভালোবাসা সত্যিকারভাবেই ছিল হলিউডকে কেন্দ্র করে। তো, একদিন বস তাকে বললেন, “ঠিক আছে, তুমি আর লরা যদি আভাঁগার্দের ব্যাপারে ইদানীং এতটাই আগ্রহী হয়ে থাকো, তোমরাই একটা ছবি বানাও না কেন?” আর এভাবেই সবকিছুর শুরু ।
বরঞ্চ, আমরা চেয়েছি ঐ সমস্ত ভাববস্তুকে গভীরতর, প্রশস্ততর ও বিশদীকরণের কাজে এবং ওগুলোকে কী উপায়ে পর্দায় স্থানান্তরিত করা যায় সে–বিষয়ে চিন্তা করার কাজে ফিল্মকে ব্যবহার করতে। এখনকার দিনে একে বলা হবে ‘নিবন্ধ চলচ্চিত্র’, কিন্তু আমাদের ফিল্মকে আমরা ভেবেছি তত্ত্বীয় চলচ্চিত্র হিসাবে কেননা আমাদের বিশ্বাস ছিল লেখালিখিতে আমরা ঐ ধরনের কাজই করছিলাম, আর সেটা ছিল আমাদের লেখালিখিকে ভিন্ন এক মাধ্যমে সম্প্রসারিত করার একটা উপায়।
এ গে: পেনথেসিলিয়ার ভাবনাটা কীভাবে এলো?
ল মা: আমার মনে হয়, এখানে জোর দিয়ে বলার কথাটা বোধ হয় এই যে, যখন আমরা ছবি বানাতে শুরু করব বলে সিদ্ধান্ত নিলাম তখন আমাদের দিনানুদিনের মগ্নতা থেকে, যেসব ভাববস্তুর ব্যাপারে আমরা আগ্রহী ও যেসব নিয়ে আমরা প্রায়ই কথা বলি যেসবের থেকে, আচানক এক লাফে দূরে সরে যেতে আমরা চাই নি। বরঞ্চ, আমরা চেয়েছি ঐ সমস্ত ভাববস্তুকে গভীরতর, প্রশস্ততর ও বিশদীকরণের কাজে এবং ওগুলোকে কী উপায়ে পর্দায় স্থানান্তরিত করা যায় সে-বিষয়ে চিন্তা করার কাজে ফিল্মকে ব্যবহার করতে। এখনকার দিনে একে বলা হবে ‘নিবন্ধ চলচ্চিত্র’, কিন্তু আমাদের ফিল্মকে আমরা ভেবেছি তত্ত্বীয় চলচ্চিত্র হিসাবে কেননা আমাদের বিশ্বাস ছিল লেখালিখিতে আমরা ঐ ধরনের কাজই করছিলাম, আর সেটা ছিল আমাদের লেখালিখিকে ভিন্ন এক মাধ্যমে সম্প্রসারিত করার একটা উপায়। তবে, অধিকন্তু, যেগুলোকে আমরা ঋণাত্মক নন্দনশৈলী হিসাবে ভাবতাম—শূন্যে, প্রত্ন পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন—সেগুলো ব্যবহার করছিলাম: আখ্যানিক প্রথা, দৃশ্যগত প্রথা, দৃষ্টিকোণ প্রভৃতির মূলে থাকা সিনেমার অনেকগুলো প্রথা থেকে দূরে দাঁড়িয়ে। এর জন্য আমাদের কৌশল ছিল সম্পাদনা এড়ানো। গোটা এক চাক ফিল্মকে একেকটা একক হিসাবে ব্যবহার করে আমরা নিরবচ্ছিন্ন, সুদীর্ঘ শট নিয়ে নিয়ে শুটিং করছিলাম। চিন্তাগুলোর মূলে সরাসরি ছিল ল্যুস ইরিগারে ও জুলিয়া ক্রিস্তেভা কর্তৃক প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাবিত নারীবাদী মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বের উত্থাপিত প্রশ্নমালা: ইডিপাস গূঢ়ৈষণার ফ্রয়েডীয় ও লাকানীয় ধারণা এবং এতে মায়ের অবস্থান কোথায় তা নিয়ে তাঁদের ছুড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জসমূহ। সুতরাং, অনেকভাবেই, গ্রিক পুরাণকে আমরা ব্যবহার করছিলাম মায়ের অবস্থানকে লাকানীয় প্রতীকায়নের বাইরে বিবেচনা করার উপায় হিসাবে। অতএব, আমার মনে হয় ভাষা, এবং ভাষার সঙ্গে নারীর সম্পর্ক, ছিল আমাদের ফিল্মজুড়ে বহমান কেন্দ্রীয় ভাবধারা, আর আমরা আমাজনদের ব্যবহার করছিলাম এক ধরনের দৃশ্যপ্রতিমা হিসাবে, এর সমাধান করার জন্য এবং সংস্কৃতির সব ধরনের খণ্ডাংশকে একত্রে একই সময়ে উপস্থাপনের কাজে।
এ গে: আপনার দ্বিতীয় ছবি, রিডল্স্ অফ দা স্ফিংস, বিএফআই-এর আর্থিক অনুদান পেয়েছিল। তাঁরা সবাই এরকম নিরীক্ষাধর্মী একটি ছবিকে অনুদান দেওয়ার বিরোধী ছিলেন কিনা আপনার মনে আছে?
ল মা: হ্যাঁ, অনুদান বোর্ডে থাকা এক বন্ধুর কাছ থেকে আমি শুনেছিলাম যে ওটা খুব কষ্টসাধ্য ছিল, কিন্তু একইসঙ্গে, ১৯৭৫ সাল নাগাদ এদেশে সত্যিই কোনো স্বাধীন চলচ্চিত্র আন্দোলন ছিল না এবং ফলত অনেকরকম চাপ জমা হচ্ছিল সাধারণভাবে শিল্পের জগতে: পত্রপত্রিকা, লেখালিখি, চলচ্চিত্র উৎসব, ফিল্ম থিয়েটারের নানান মৌসুম, নিবন্ধচক্র, আলোচনাসভা… অতএব, বোর্ডের মঞ্জুরি পাওয়া রিডল্স্-এর পক্ষে দুরূহ হলেও এরকম ছবিকে অনুদান দেওয়ার ক্ষেত্রে আগের যে-কোনো সময়ের চাইতে তখন অনেক বেশি খোলামন ও বৃহত্তর সম্ভাবনা হাজির ছিল।
এ গে: রিডল্স্-এর প্রথম পর্বে আপনি হাজির হয়ে স্ফিংস বিষয়ে ছোট্ট একটা ইতিহাস-পাঠ দেন। আপনার ছবি তৈরির প্রজেক্টে ‘আধিকারিক’-এর স্বচ্ছতা কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল তা বুঝিয়ে বলতে পারেন?
ল মা: আগের একটা ছবিতে পিটার এটা করেছিল। বেশ লম্বা ও সবিস্তার একটা বক্তৃতা দিয়েছিল: রিডল্স্-এ দেওয়া আমারটার চাইতে অনেক বেশি বিস্তারিত। এটা ছিল আমাদের নন্দনতাত্ত্বিক কৌশল সংকরায়নের অংশ যে পরিচালক ক্যামেরার সামনে হাজির হয়ে সরাসরি কথা বলবেন। ছবিকে তার নিজস্ব সময়ের ভেতর থেকে বের করে যেভাবে আমরা তাকে সরাসরি সম্বোধনের জগতে নিয়ে গিয়েছিলাম, এটা ছিল তারই অংশ। আমি নিশ্চিত যে আমি বেশ নারাজ ছিলাম, কিন্তু অন্য কোনো উপায় ছিল না: সেটা ছিল আমার পালা আর যেভাবে আমরা ছবি বানাতাম ওটা তার অংশ ছিল। আমার অংশ ধারণ করতে তাদের একটু অসুবিধা হয়েছিল, কারণ হেসে ফেলা বা শব্দ ভুলে যাওয়ার বাতিক ছিল আমার।
এ গে: রিডল্স্ যে আদ্যোপান্ত ৩৬০-ডিগ্রি ক্যামেরা প্যানে ভরা, সে-ব্যাপারে কিছু বলতে পারেন? ভাবছি ওটা শাঁতাল আকের্মানের লা শাম্ব্র (১৯৭২) দ্বারা অনুপ্রাণিত ছিল কিনা: আমি জানি যে-বছর এটা বেরোয় সে-বছর আপনি এডিনবরার উইমেন্স্ ফিল্ম ফেস্টিভালে তাঁর কিছু ছবির আয়োজন করেছিলেন।
ল মা: হ্যাঁ, তা-ই, লা শাম্ব্র তৈরি হয় রিডল্স্-এর আগে, আর ন্যাশনাল ফিল্ম থিয়েটারে সিমন ফিল্ড ও ডেভিড কার্টিসের আয়োজনে আভাঁগার্দ ছবির আন্তর্জাতিক এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবং যেখানে অনেকগুলো চমৎকার ছবি দেখানো হয়। আমি আর পিটার শাঁতাল আকের্মানের ছবি তখনই প্রথমবার দেখি, এবং ইভন রাইনার ও জয়েস উইল্যান্ডের ছবিও। হঠাৎ করে তখন একটা আবহ তৈরি হয় যে নয়া আভাঁগার্দ নন্দনে নারীরা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন এবং চলচ্চিত্রীয় ভাষাকে সবসময়ই এমনভাবে মোকাবেলা করছিলেন যা নারী ছাড়া অন্য কারো পক্ষে তৈরি করা সম্ভব নয়। ৩৬০-ডিগ্রি প্যানের ব্যাপারটা নির্দিষ্ট কারোর প্রভাব থেকে নয়, বরং ক্যামেরার জটিল সঞ্চলনের প্রতি আমাদের পুরনো প্রেম থেকেই আসা। চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তখন ৩৬০-ডিগ্রি প্যান ছিল মাত্র কয়েকটি, এবং এ-ব্যাপারে আমরা বেশ সচেতন ছিলাম। অবশ্য, এ ছাড়াও, ৩৬০-ডিগ্রি প্যান খুবই কাজের ছিলো কেননা এই চক্রাকার সঞ্চলন স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং তা সম্পাদনার প্রশ্নকে বাতিল করে দেয়। পরবর্তী কালে হেলেন সিক্সু এবং ল্যুস ইরিগারে কর্তৃক তত্ত্বায়িত নারীত্বের ধারণার সঙ্গে এর অভিজাত অনুনাদের কথা আমাদের ভাবনায় আসে: বৃত্তাকার, চক্রাকার, বদ্ধাতঙ্ক, গার্হস্থ্য জমিন; আরাম, মাতৃজঠর-সম কিছু… আমার মনে হয় প্রথমে আমরা চলচ্চিত্রগত দিকটা নিয়েই বেশি ভাবিত ছিলাম, আর সাংস্কৃতিক অনুনাদের ব্যাপারটা এর পরে ঘা মারে।
এ গে: অবিরাম ৩৬০-ডিগ্রি প্যান স্থির নজরকে অসম্ভব করে তোলে। এই ব্যাপারটা আর ‘ভিজুয়াল প্লেজার এন্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’য় আপনার ঘোষিত স্থির পুরুষ-নজর এই দুয়ের মধ্যে একটা রেখা টেনে যদি বলি চলচ্চিত্র নির্মাণ, নিজের অজান্তেই, আপনার লেখা দ্বারা প্রাণিত, তবে কি অতিসরলীকরণ হয়ে যায়?
ল মা: আমার মনে হয় একটা স্থিরীকৃত নজরের, শনাক্তযোগ্য দৃষ্টিকোণের, বিরুদ্ধে প্রতিরোধবোধটা নিশ্চিতভাবেই ছিল। এর প্রতি গভীর এক দায়বদ্ধতা ছিল আমাদের, আভাঁগার্দ ও নারীবাদী কৌশল দুই দিক থেকেই।
এ গে: আর আপনার ও পিটারের চলচ্চিত্রনির্মাণ যেহেতু আপনাদের তাত্ত্বিক লেখাগুলোর সফল তর্জমা করেছে, সেহেতু আপনারা কি কখনো ভেবেছিলেন কাউন্টার-সিনেমা ভবিষ্যতে হলিউডকে পরাজিত করবে, নাকি আপনারা তখনও জানতেন যে হলিউডই কর্তৃত্ব করবে?
ল মা: ঐ সময়টায় আমাদের খুব জোরালোভাবে মনে হয়েছিল যে হলিউডের দিন শেষ। আপনি যদি ১৯৭২ সালে এডিনবরায় উইমেন্স্ ফিল্ম ইভেন্টের সময়টায় আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, তাহলে আমি বলতাম হলিউড ছবি বানাতে থাকবে, কিন্তু এর চলচ্চিত্রীয় বা বাণিজ্যিক শক্তিমত্তা আর আগের মতো থাকবে না।
এ গে: আর এডিনবরার উইমেন্স্ ফিল্ম ইভেন্টের জন্য আপনি কী বেছে নিয়েছিলেন?
ল মা: ঐ অনুষ্ঠানে আমরা চেয়েছিলাম নারী নির্মিত চলচ্চিত্রের যাকে বলতাম অন্তর্ঘাতমূলক প্রবণতা তাকে ধরতে, সুতরাং, উদাহরণস্বরূপ, ভেরা চাইতিলোভার ডেইজিস ছিল তেমন একটা ছবি যাকে আমরা খুব মূল্য দিতাম; নেলি কাপলানের লা ফিয়াঁসে দ্যু পিরাৎ; মায়া ডেরেনের কাজ। অনুষ্ঠানটির বিরাট সাফল্যের অন্যতম ছিল ডরোথি আর্জনারের ডান্স, গার্ল, ডান্স-কে খুঁজে পাওয়া: এটা আবিষ্কার করা যে হলিউডে তেমন একজন নারী কাজ করে যাচ্ছেন এবং এমন অন্তর্ঘাতী শক্তিমত্তাসম্পন্ন একটা ছবি খুঁজে পাওয়া।
এ গে: ভিন্ন ভিন্ন পটভূমি থেকে নারী শিল্পীদেরকে এনে তাদের মধ্যকার অমিলসমূহের পরিবর্তে মিলগুলোকে খুঁজে বের করার ক্ষেত্রে আপনাদের যে-তৎপরতা সেটা ফ্রিদা কাহলো ও তিনা মোদোত্তিকে নিয়ে আপনার ও পিটারের নির্মিত ছবিতেও স্পষ্ট। এই প্রকল্পের শুরু কিভাবে?
ল মা: সম্ভবত প্রথম পর্বে, কেননা আমাদের আগ্রহ ছিল দুয়ের দশকের এমন আভাঁগার্দ খুঁজে বের করা যা সোভিয়েতেরটার চাইতে বেশ আলাদা। ফ্রিদা কাহলো অ্যান্ড তিনা মোদোত্তি [১৯৮৪] ছিল, হোয়াইট চ্যাপেল গ্যালারিতে আমরা এই দুই শিল্পীর যে-প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিলাম সেটার যৌক্তিকতার একটা দলিল। ভাবনাটা ছিল এমন দুই নারী শিল্পীর কাজকে ফুটিয়ে তোলা যাঁরা খুবই ভিন্ন ছিলেন: একজন চিত্রশিল্পী, অন্যজন আলোকচিত্রী, আধুনিকতাবাদ বিষয়ে বেশ আলাদা দৃষ্টিভঙ্গি সম্পন্ন, কিন্তু উভয়েই প্রায় একই সময়ে একই ধরনের প্রভাব ও রাজনৈতিক অবস্থান থেকে মেহিকোতে কাজ করছিলেন। আমার মনে হয়, আমাদের কিউরেটিং কৌশলগুলো কী হবে তা নির্ধারণ করার প্রয়াস থেকে আমরা ছবিটা বানিয়েছিলাম। ছবিটার যে-সমস্যাটা আমার মনে ছিল—সত্যি বলতে, মনে হয় আমি যতটা ভেবেছি পিটারও ততটাই ভেবেছে—সেটা হলো নেপথ্যভাষ্যটা আমরা ঠিকঠাকমতো করতে পারি নি। আর্টস্ কাউন্সিল ছবিটা তৈরি করেছিল তাদের শিক্ষামূলক কর্মকাণ্ডের অংশ হিসাবে আর আমাদের খুব জোরালোভাবে মনে হয়েছিল যে আরো নিরীক্ষাধর্মী কোনো পরিবেশে এর চাইতে অনেক বেশি ভাঙা-ভাঙা, বিক্ষিপ্ত সাউন্ডট্র্যাক নিয়ে ছবিটা নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারতো, কিন্তু শিক্ষণ-উপকরণ হিসাবে যেতে হলে নেপথ্যভাষ্যের প্রয়োজন ছিল এবং আমার মনে হয় না যে আমরা একে যথেষ্ট অনুপুঙ্খ করেছিলাম—এটা অত্যন্ত সাদামাটা ছিল। পর্যাপ্ত বিভঙ্গীকরণ এতে নেই, যথেষ্ট সংকর এটা নয়। সমস্যাটা মনে হয় এই ছিল যে, ও আর আমি ক্যাটালগের জন্য যে-নিবন্ধগুলো লিখেছিলাম সেগুলোর ভিত্তিতেই ওটা বানানো, ফলত আপনি কোনো কিছুর ওপর একবার লিখে ফেলার পর সেটাকে পুনর্ব্যবহার না করাটা যে কঠিন, সেই ব্যাপারটা একে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। তবে, সৎভাবে বলে গেলে, এই সত্য আমাকে স্বীকার করতেই হবে যে পিটার আর আমি যেসব কাজ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যে ঐ প্রদর্শনীটি সবচেয়ে প্রভাবসঞ্চারী কাজগুলোর অন্যতম ছিল, কেননা এটা ফ্রিদা কাহলোকে দৃষ্টির গোচরে ফিরিয়ে আনে। দুইয়ের ও তিনের দশকে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন, কিন্তু মূলত দিয়েগো রিভেরার স্ত্রী হিসাবে, অথচ এখন সেলিব্রিটি সংস্কৃতির বিচারে দিয়েগোকে তিনি নিশ্চিতভাবেই আড়ালে ঠেলে দিয়েছেন। তবে, আপনি জানেন যে শিল্পীরা চোখের আড়াল হয়ে যান এবং সেই সময়ে তাঁর ব্যাপারে আগ্রহী লোক কেবল আমরাই ছিলাম না। ওটা ছিল মেহিকান রেনেসাঁসের প্রতি আগ্রহের পুনর্জাগরণের মুহূর্ত এবং, কথায় যেমন বলে, ওটা ছিল ‘আকাশে বাতাসে’।
এ গে: ’৮৪ তে এসে আপনার আর পিটারের চলচ্চিত্র নির্মাণের যৌথতার অবসান ঘটে। পেছন ফিরে দেখলে, আপনার কি মনে হয় যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিশেষ কালপর্বই নির্মাণকে সম্ভব করেছিল এবং তা তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল?
ল মা: আমরা যে-আন্দোলনের অংশ ছিলাম, যেটা সাতের দশকের শেষের দিকেই সত্যিকার অর্থে সফলকাম হয়েছিল, সেটা তখন কিছু মাত্রায় ভেঙে পড়েছিল এবং এর অনুকূল পরিবেশও ঠিক ছিল না আর। এই সত্য আমাদেরকে প্রায় আচ্ছন্ন করেছিল যে, অত সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলটা দিশাহীনতায় পর্যবসিত হয়েছিল। পেছন ফিরে তাকিয়ে বলতে পারি যে ওটা ছিল এক ধরনের হতাশা, কিন্তু ব্যাপারটা সেই সময় খানিকটা প্রতিক্রিয়াশীল বলে বিবেচিত হতো। কিন্তু পিটার আর আমার কাছে আকাশকুসুম স্বপ্নের ভাবটা আর ছিল না: একটা সিনেমা দুনিয়াকে পাল্টে দিতে পারে কিংবা চলচ্চিত্রের মাধ্যমে আমরা কারোর দৃষ্টিভঙ্গিকে পাল্টে দিতে পারি, সেই ভাবটা।
হ্যাঁ, ওটা খুব সুষম ছিল আর প্রচুর আলোচনা, পড়াশোনা, গবেষণা ও পুনঃসম্পাদনের মাধ্যমে তা আসে। সম্প্রতি আমি আমাদের পুরনো নোটখাতাগুলো দেখছিলাম এবং আপনি দেখতে পাবেন যে ভাবনাগুলোকে বারংবার ফিরে ফিরে পুনঃসম্পাদন করা হয়েছে: বুদ্ধিবৃত্তিক ও চলচ্চিত্রীয় উভয় দিক থেকেই। তবে সেখানে শ্রম–বিভাজনও ছিল, এ–অর্থে যে পিটার আমার চাইতে অনেক বেশিমাত্রায় লেখক তথা প্রবন্ধকার, কবি, সাংবাদিক ছিল।
এ গে: পেছন ফিরে দেখলে আপনার কি মনে হয় যে আপনাদের চলচ্চিত্রিক সহযোগের বিষয়টি সুষম ছিল? আপনারা কিভাবে এটা নিশ্চিত করেছিলেন?
ল মা: হ্যাঁ, ওটা খুব সুষম ছিল আর প্রচুর আলোচনা, পড়াশোনা, গবেষণা ও পুনঃসম্পাদনের মাধ্যমে তা আসে। সম্প্রতি আমি আমাদের পুরনো নোটখাতাগুলো দেখছিলাম এবং আপনি দেখতে পাবেন যে ভাবনাগুলোকে বারংবার ফিরে ফিরে পুনঃসম্পাদন করা হয়েছে: বুদ্ধিবৃত্তিক ও চলচ্চিত্রীয় উভয় দিক থেকেই। তবে সেখানে শ্রম-বিভাজনও ছিল, এ-অর্থে যে পিটার আমার চাইতে অনেক বেশিমাত্রায় লেখক তথা প্রবন্ধকার, কবি, সাংবাদিক ছিল। গত বছর হোয়াইটচ্যাপেল গ্যালারিতে আমাদের রেট্রোস্পেক্টিভে যখন ছবিগুলো আবার দেখলাম তখন পিটারের লেখার গুরুত্ব এবং ছবিগুলোতে এর অবদান যে কতখানি সেটা উপলব্ধি করে আমি অবাক হলাম। আমরা যখন চ্যালেন ৪-এর জন্য দা ব্যাড সিস্টার [১৯৮৩] বানাতে যাই, বাজেটটা অনেক বড় ছিল আর সেটা ছিল তুলনামূলকভাবে প্রথাগত আখ্যান। এতে একত্রে কাজ করা আমাদের জন্য কঠিনতর ছিল, কেননা আগে আমাদের এতটাই পরিষ্কারভাবে ছক করা কর্মকৌশল থাকত যে—খানিকটা ভানসর্বস্ব শোনাবে, জানি—এটা ছিল অনেকটা হিচকক যেমন বলেছিলেন: “ক্যামেরাম্যান আমার সঙ্গে মিথ্যে বলছে, কেবল এটুকু তাকে বলার জন্যই কেন আমি ক্যামেরার ভিতর দিয়ে তাকাতে যাব?” দেখুন, ছবি বানানোর শুরু থেকেই আমরা জানতাম আমরা কী চাই এবং ছবির পরিকল্পনা এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে রাখা হত যে সম্পাদনার ব্যাপারে আলাপ করার খুব একটা কিছু থাকত না। কিন্তু দা ব্যাড সিস্টার-এর বেলায় ব্যাপারটা আলাদা ছিল আর তখনই আমরা অনুভব করলাম যে আমাদের যৌথতা আর কাজ করছে না। এর জন্য অংশত দায়ি ছিল ভিডিয়োর নয়া দুনিয়া আর নিরীক্ষাধর্মী মিউজিক ভিডিয়ো আর আটের দশকের গোড়ায় বাড়তে থাকা নতুন নন-সেলুলয়েড, এবং অর্থায়নের মূল উৎস তখন চ্যানেল ফোর।
এ গে: আপনার কি মনে হয় যে আপনি ছবি বানাতে শুরু করার পর থেকে দর্শকের অবস্থান পরিবর্তিত হয়েছে?
ল মা: হ্যাঁ, পুরনো আভাঁগার্দ দিনগুলোতে আমরা মনে করতাম দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণ করা আর দর্শককে সক্রিয় করে তোলার উপায় খুঁজে বের করা উভয়ই পরিচালকের দায়িত্ব। বোধ হয়, বিশেষ এক ধরনের দেখনদারি সৃষ্টির দায়ভার চলচ্চিত্রের নন্দনতাত্ত্বিক নিরীক্ষামূলক কৌশলের ওপর বর্তায় বলে আমরা মনে করতাম। কিন্তু এখন মানুষ বিপুল বিভিন্নভাবে ছবি দেখে বলে, আমার মনে হয় এ-ব্যাপারটা আগাগোড়া উল্টে গেছে, আর এখন সক্রিয় দর্শক হওয়ার এবং যে-কোনো ধরনের ছবির সঙ্গে কল্পনাপ্রতিভা ও কাব্যবোধ নিয়ে অংশগ্রহণ করার দায়ভারটা বর্তায় দর্শকের ওপর। উদাহরণস্বরূপ, আমি খেয়াল করেছি নয়ের দশকে আমি আমার পুরনো প্রিয় হলিউডি ছবিগুলোর কাছে ফিরে যাই এবং ওগুলো আবার দেখতে থাকি, কিন্তু সম্পূর্ণ ভিন্ন চোখে।
এ গে: আর ২০১৫ সাল ছিল ‘ভিজুয়াল প্লেজার অ্যান্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’র ৪০তম বর্ষপূর্তি। আপনার কি মনে হয় ওটাকে আপনি ভিন্নভাবে মোকাবেলা করছেন?
ল মা: হ্যাঁ, কয়েক বছর আগে এর সঙ্গে আবার বোঝাপড়ায় আসতে হয়েছিল আমাকে, এবং বুঝতে পেরেছিলাম যে এর বক্তব্য বিষয়ের শুদ্ধতার বা শুদ্ধতার ঊনতার চাইতে একটি বিসংবাদাত্মক প্রবন্ধ বা, আমার বিদ্যায়তনিক বন্ধু ম্যানডি মার্ক যেমন বলেছিল, ইশতেহার হিসাবেই একে দেখার প্রতি আমার আগ্রহ বেশি ছিল। এবং ইশতেহার বা বিসংবাদাত্মক লিখার মতো এটাও এক-নাকি-দুই-ভাবধারার রচনা আর আমার মনে হয় সেটাই এর শক্তি। এখন দেখতে পাচ্ছি যে জনহিতকর এমন কিছু কথা আমি বলতে পেয়েছিলাম যেগুলো জনমানসে স্থান করে নিয়েছিল, নানাভাবে যেগুলো পুনরুদ্ধৃত ও পুনর্ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আমার আরও মনে হয় যে এর হিচককীয় দিকটা অতিরিক্ত গুরুত্ব পেয়ে গেছে আর স্টার্নবার্গীয় দিকটা—যেটা জটিলতর আর যেটার সাধারণীকরণ সহজ নয়—কিছুটা হারিয়ে গেছে। ভাবছি ওটাতে আবার হাত দেব, রতিদৃষ্টির দিকটার বদলে কামারতির দিকটাকে বিশদ করব। তবে, সেই সঙ্গে, আমার মনে হয় প্রবন্ধটি আমার ঐ ভাবনাগুলোকে প্রভাবিত করেছিল যেগুলো [আমার ২০০৬ সালের প্রকাশনা] ড্যাথ ২৪x আ সেকেন্ড-এ স্থান পায়: স্থিরতার প্রতি সেই আগ্রহ এবং ‘ভিজুয়াল প্লেজার এন্ড ন্যারেটিভ সিনেমা’র সেই রতিদৃষ্টিময় দর্শকের মধ্যে কিছু মাত্রায় সেই নিবিষ্ট দর্শক প্রোথিত, এই ভাবনা। উপরন্তু এই ভাবনাও যে, প্রদর্শনীতে নারী কুশীলবকে দৃশ্যবস্তু হিসাবে উপস্থাপন আদতে ছবিটিকে থামিয়ে দেয় ও স্থগিত করে, এবং লালসাময় দৃষ্টি গতিশীলতায় নয় বরং স্থিতিশীলতাতেই নিবদ্ধ, ফলে, এমনকি নাচ বা গান থাকলেও অ্যাকশন ফিল্মের সাধারণ আখ্যানিক শৃঙ্খল এবং প্রবহমাণতার মধ্যে আদতে সেটা স্থগিতায়িত মুহূর্ত। অতএব, যখন আমি নিবিষ্ট দর্শক সম্পর্কে লিখছিলাম তখন এর ভাবাদর্শগত নিহিতার্থ যদিও খুবই আলাদা ছিল, তথাপি একই সঙ্গে আমার মনে হয় যে এর সঙ্গে পুংদৃষ্টির তথা লালসাময় দৃষ্টির এবং কিভাবে চলচ্চিত্রীয় দৃষ্টি রূপান্তরিত ও পুনর্বিবেচিত হতে পারে সেই প্রশ্নটির কোনো একধরনের সম্পর্কসূত্র ছিল। প্রবন্ধটার ক্ষেত্রে, হলিউডি ছবির সীমারেখার ভিতরেই আমি কাজ করছিলাম। পরের বছরগুলোতে আমি জাতির প্রশ্ন এবং হলিউডে আফ্রিকান আমেরিকান কুশীলব ও মেধার অনুপস্থিতির প্রসঙ্গে ভেবেছি এবং ভেবেছি কেমনভাবে হলিউড আদতে একটা বর্ণবাদী সিনেমাঞ্চল ছিল।
এ গে: আর, সবশেষে, আপনার পক্ষে সম্ভব হলে আপনার তরুণ সত্তাকে আপনি এখন কী উপদেশ দিতেন?
ল মা: ছোট্ট করে ভাবো। প্রত্যেকটা দিনকে নিয়ে ভাবো, এবং ওখান থেকে বেরিয়ে আসো।