কোন চিত্রকর যখন শুধু তার কাজ দেখানোর জন্য নয়, বরং চিত্রশিল্প সম্পর্কে তার ধ্যানধারণা প্রকাশ করার জন্য জনতার দরবারে এসে উপস্থিত হয়, তখন সে বিবিধ বিপদের সম্মুখীন হয়।
প্রথমত, বহু লোকই যখন ছবিকে সাহিত্যেরই একটা উপাঙ্গ বলে ভাবতে ভালোবাসে, ফলে চায় যে তা চিত্রগত সাধারণ ধারণা নয়, বরং বিশেষত সাহিত্যগত ধারণা প্রকাশ করুক, তখন আমার ভয় হয় যে সাহিত্যিকদের এলাকায় কোন চিত্রকর হানা দেওয়ার উপক্রম করলে তারা ভারি আশ্চর্য হয়ে তাকে দেখবে। বস্তুত, আমি এ-বিষয়ে সচেতন যে একজন চিত্রকরের শ্রেষ্ঠ মুখপাত্র হল তার কাজ।
যদিও সিনা, দেভ্যালিয়ে, দেনি, ব্লঁস, গের্যাঁ বা বের্নার-এর মতো শিল্পীরা এইসব বিষয় নিয়ে লিখেছেন এবং বিভিন্ন সাময়িকপত্রে তা সাদরে গৃহীত হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে আমি চেষ্টা করব লেখার শৈলী নিয়ে বেশি না ভেবে সোজাসরলভাবে একজন চিত্রকর হিসেবে আমার অনুভূতি ও আকাঙ্ক্ষার কথা বিবৃত করতে।
কিন্তু এখন আমি নিজেই নিজের বিরোধিতা করার যে-বিপদ, তার সম্ভাবনা আগাম টের পাচ্ছি। আমার আগেকার কাজ আর এখনকার কাজের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আমার অনুভূতি খুবই গভীর, কিন্তু এ-নিয়ে আমি গতকাল যা ভেবেছি তার সঙ্গে আমার আজকের ভাবনা হুবহু এক নয়। অথবা বলা যায়, আমার মূলগত ভাবনা বদলায়নি, কিন্তু আমার ভাবনা ইতোমধ্যে বিবর্তিত হয়েছে, এবং আমার অভিব্যক্তির ধরণ তাকে অনুসরণ করেছে। আমার কোন ছবিকেই আমি অস্বীকার করছি না, কিন্তু যদি তা আবারও করার দরকার হয় তো সেইসব ছবির মধ্যে এমন একটাও নেই যা আমি অন্যভাবে করব না। গন্তব্য সর্বদা এক, কিন্তু সেখানে পৌঁছনোর জন্য আমি নতুন কোন পথের সন্ধান করব।
শেষত, এখানে যদি আমি অমুক শিল্পী বা তমুক শিল্পীর নাম করি তা শুধু এটা দেখানোর জন্য যে কোথায় আমাদের ধরণ আলাদা, কিন্তু তাতে মনে হতে পারে যে আমি বোধ হয় তাঁর কাজকে ছোট করছি। ফলে যে-সমস্ত শিল্পীর লক্ষ্য এবং পরিণাম আমি সবচেয়ে ভালো বুঝি বা যাঁদের সাফল্যের আমি প্রশংসা করি সবচেয়ে বেশি, এভাবে তাঁদের প্রতি অবিচারের অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছি আমি, যদিও এখানে তাঁদের কথা উল্লেখ করব শুধু দৃষ্টান্ত হিসেবে, তাঁদের মধ্যে আমার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য নয়, বরং তাঁরা কী করেছেন তার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট করে দেখানোর জন্য যে আমি কী করার চেষ্টা করেছি।
সবার ওপরে আমি যার সন্ধান করি, সে হল অভিব্যক্তি। কখনও-কখনও এ কথা স্বীকার করা হয় যে আমার কিছু প্রায়োগিক দক্ষতা আছে, কিন্তু সে যা-ই হোক, আমার উচ্চাশা খুবই সীমিত, একটা ছবি দেখে যে-বিশুদ্ধ চাক্ষুষ তৃপ্তি লাভ করা যায় তার বাইরে আর কিছু তা আশা করে না। কিন্তু একজন চিত্রকরের চিন্তাকে তার চিত্রপদ্ধতির থেকে আলাদা করে দেখা ঠিক হবে না, কারণ চিন্তার গুরুত্ব এই পদ্ধতির প্রয়োগে লব্ধ অভিব্যক্তির চেয়ে বেশি নয়, এবং সে চিন্তা যত গভীর হবে এই পদ্ধতি ততই পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠবে (পূর্ণাঙ্গ মানে কিন্তু এখানে জটিল নয়)। জীবন সম্পর্কে আমার অনুভূতি এবং তাকে যে-পদ্ধতিতে আমি ভাষান্তরিত করি, তার মধ্যে আমি কোন পার্থক্য করতে অপারগ।
কোন ছবিতে যা-কিছু প্রয়োজনীয় নয়, সে-সবই তার পক্ষে ক্ষতিকর। সামগ্রিকভাবে শিল্পকে হতে হবে সুসঙ্গত : অনাবশ্যক কোন অনুপুঙ্খ থাকলে দর্শকের মন থেকে তা অপরিহার্য কোন অনুপুঙ্খকেও সরিয়ে দিতে পারে।
মানুষের মুখে তীব্র আবেগের দীপ্তিতে বা প্রচণ্ড আলোড়নের প্রকাশেই শুধু অভিব্যক্তি বাস করে বলে আমি অন্তত মনে করি না। আমার ছবির সামগ্রিক বিন্যাসই অভিব্যক্তিময় : অবয়বসমূহ সেখানে যে-স্থান দখল করে থাকে, তাদের চারপাশে যে-শূন্যস্থান, তার অনুপাত, সব কিছুরই সেখানে ভূমিকা আছে। রচনাসংস্থান হল চিত্রকরের নির্দেশে তার অনুভূতি প্রকাশের জন্য আলঙ্কারিক পদ্ধতিতে বিবিধ উপাদানকে সুবিন্যস্ত করার শিল্প। একটা ছবিতে তার সমস্ত অংশই দৃশ্যমান হওয়া উচিত, আর প্রধান হোক বা গৌণ, সে-সবেরই সুনির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করা উচিত। কোন ছবিতে যা-কিছু প্রয়োজনীয় নয়, সে-সবই তার পক্ষে ক্ষতিকর। সামগ্রিকভাবে শিল্পকে হতে হবে সুসঙ্গত : অনাবশ্যক কোন অনুপুঙ্খ থাকলে দর্শকের মন থেকে তা অপরিহার্য কোন অনুপুঙ্খকেও সরিয়ে দিতে পারে।
কোন শিল্পী যদি একই রচনা ছোট ক্যানভাস থেকে তার চেয়ে বড় কোন ক্যানভাসে আঁকতে চায়, তবে তার অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রাখতে নতুন করে তাকে তা ভাবতে হবে; শুধু বড় ক্যানভাসে স্থানান্তরিত করলেই হবে না, তার চরিত্রও তাকে পালটাতে হবে।
রচনাসংস্থান, যার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত অভিব্যক্তি, যে-তলকে তা আবৃত করে তদনুসারে রূপান্তরিত হয়। আমি যদি একটা নির্দিষ্ট মাপের কাগজ নিই তো তার সঙ্গে আমার রেখাচিত্রের একটা আবশ্যিক সম্পর্ক আছে। ভিন্ন অনুপাতের আর-একটা কাগজে, ধরা যাক বর্গাকারের বদলে তা যদি আয়তাকার হয়, তবে ঐ একই ড্রয়িং আমি সেখানে করব না। কাগজটা নিছক আকারে বড় হলেও আমার তৃপ্তি হবে না যদি ঐ একই ড্রয়িং একই আকারের, কিন্তু দশ গুণ বড় কাগজে আমাকে করতে হয়। একটা ড্রয়িংয়ে সেই বিস্তৃতি থাকতে হবে যা তার চারপাশের বস্তুতে প্রাণসঞ্চার করবে। কোন শিল্পী যদি একই রচনা ছোট ক্যানভাস থেকে তার চেয়ে বড় কোন ক্যানভাসে আঁকতে চায়, তবে তার অভিব্যক্তি অপরিবর্তিত রাখতে নতুন করে তাকে তা ভাবতে হবে; শুধু বড় ক্যানভাসে স্থানান্তরিত করলেই হবে না, তার চরিত্রও তাকে পালটাতে হবে।
রঙের সুসঙ্গতি ও অসঙ্গতি, দুয়েরই পরিণতি হতে পারে মনোরম। আমি যখন কাজ শুরু করি, তখন প্রথম পর্যায়ে প্রায়ই আমি সতেজ ও বাহ্যিক ইন্দ্রিয়-সংবেদনকে নথিভুক্ত করি। কয়েক বছর আগে কখনও-কখনও তাতেই আমি বেশ সন্তুষ্টি লাভ করতাম। কিন্তু এখন যদি আমি তাতেই সন্তুষ্ট হই, যখন কিনা আমার মনে হয় যে তার চেয়ে বেশিদূর অবধি আমি দেখতে পাই, তবে আমার ছবিতে একধরনের অস্পষ্টতা আসবে : আমি হয়তো মুহূর্তের চকিত সংবেদনকে নথিভুক্ত করলাম, কিন্তু তা আমার অনুভূতিকে সম্পূর্ণত প্রকাশ করতে পারে না, এবং পরের দিন দেখলে তা আর আমি চিনতে পারি না।
আমি এখন সংবেদনের সেই ঘনীভূত স্তরে পৌঁছতে চাই, একটা ছবিকে যা গড়ে তোলে। এক অধিবেশনেই একটা ছবি শেষ করে আমি যথেষ্ট তৃপ্তি পেতে পারি, কিন্তু অচিরেই তা হয়ে উঠবে ক্লান্তিকর
আমি এখন সংবেদনের সেই ঘনীভূত স্তরে পৌঁছতে চাই, একটা ছবিকে যা গড়ে তোলে। এক অধিবেশনেই একটা ছবি শেষ করে আমি যথেষ্ট তৃপ্তি পেতে পারি, কিন্তু অচিরেই তা হয়ে উঠবে ক্লান্তিকর : ফলে আমি চাইব তার ওপর আবার কাজ করতে, যাতে আমার মনোগত অবস্থার প্রতিনিধি হিসেবে পরে তাকে দেখে আমি চিনতে পারি। একটা সময় ছিল যখন আমার কোন ছবি আমি দেয়ালে টাঙিয়ে চলে যেতাম না, কারণ অতিরিক্ত উত্তেজনার সেইসব মুহূর্তের কথা আমায় তা স্মরণ করিয়ে দিত এবং যখন আমি মনের শান্তি ফিরে পেতাম তখন তা দেখে আমার মোটেই ভালো লাগত না। ইদানীং আমার ছবিতে আমি প্রশান্তি আনার চেষ্টা করি, এবং যতক্ষণ না আমি তাতে সফল হই ততক্ষণ কাজ করে যেতে থাকি।
ধরা যাক, আমি কোন নারীর শরীর আঁকতে চাই : প্রথমত আমি তাকে সৌষ্ঠব ও কমনীয়তায় রঞ্জিত করতে চাই, কিন্তু আমি জানি যে তা যথেষ্ট নয়, আরও কিছু এখানে আমায় যোগ করতে হবে। আমি তার মধ্যে অপরিহার্য রেখাসমূহের সন্ধান করে এই শরীরের অর্থ সেখানে ঘনীভূত করে তুলব। প্রথম দেখায় সেখানে কমনীয়তা তত স্পষ্ট না হতে পারে, কিন্তু নতুনতর রূপে ক্রমে সেখানে তা ফুটে উঠতেই হবে, যার অর্থ তখন হয়ে উঠবে অনেক বিস্তৃত, অনেক বেশি মানবিক। কমনীয়তা সেখানে তত লক্ষণীয় না-ও মনে হতে পারে কারণ সেটাই ছবির একমাত্র গুণ নয়, কিন্তু অবয়বের সাধারণ ধারণার অঙ্গীভূত হওয়ায় তার অস্তিত্ব না থাকলেও চলবে না।
কমনীয়তা, নির্ভারতা, সতেজতা— চকিত, পলায়নপর সব সংবেদন। আমার কাছে একটা ক্যানভাস আছে যার ওপর রঙের প্রলেপ এখনও টাটকা, তার ওপর আমি আবার কাজ করতে শুরু করলাম। কোন সন্দেহ নেই যে রঙের মাত্রা তাতে ক্রমেই মলিন হয়ে আসবে। আদত রঙকে সেখানে আমি আরও বেশি ঘনত্বের রঙ দিয়ে প্রতিস্থাপিত করব, সে একটা উন্নতির লক্ষণ তো বটেই, কিন্তু চোখের কাছে তা কম সম্মোহক।
ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীদের, বিশেষত মনে আর সিসলে-র সংবেদন খুবই সূক্ষ্ম, পরস্পরের খুবই ঘনিষ্ঠ : ফলে তাঁদের ছবি দেখতেও প্রায় একই রকম। ‘ইমপ্রেশনিজম’ শব্দটা তাঁদের শৈলীর একেবারে যথার্থ দ্যোতক, কারণ তাঁরা চকিত পলায়নপর ধারণাকেই নথিবদ্ধ করেন। সাম্প্রতিক কয়েকজন চিত্রকরের ক্ষেত্রে অবশ্য এ-আখ্যা যথার্থ নয়, কারণ তাঁরা এই প্রাথমিক সংবেদনকে পরিহার করেন, এবং তাকে মনে করেন প্রতারক। কোন নিসর্গদৃশ্যের দ্রুত উপস্থাপন তার অস্তিত্বের একক কোন মুহূর্তেরই পরিচায়ক মাত্র। আমি বরং তার মূলগত চরিত্রে জোর দেব, অধিক স্থায়িত্ব লাভের জন্য বরং তার মনোহারিতা হারানোর ঝুঁকি নেব।
মুহূর্তের এই পারম্পর্য, সত্তা ও বস্তুর বাহ্যিক অস্তিত্ব যা গড়ে তোলে, এবং যা প্রতি মুহূর্তে পরিবর্তিত ও রূপান্তরিত হয়, তার গভীরে আরও সত্যতর ও আরও মূলগত চরিত্রের খোঁজ করা যায়, বাস্তবের আরও স্থায়ী ভাষ্য প্রস্তুত করার জন্য শিল্পী যাকে আঁকড়ে ধরে। ল্যুভ্র-এর ভাস্কর্যের ঘরে আমরা যখন, ধরা যাক [পিয়ের পল] পুজে-র কোন কাজের দিকে তাকাই তখন দেখি যে সেখানে অভিব্যক্তি এতটাই আরোপিত ও অতিরঞ্জিত যে তা প্রায় অস্বস্তিকর। কিন্তু লুক্সেমবুর্গে ব্যাপারটা একেবারে আলাদা; সেখানে ভাস্কররা তাঁদের মডেলকে সব সময়ে সেই ভঙ্গিতেই ধরেন যাতে তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ ও পেশির প্রসারণকে সবচেয়ে ভালোভাবে দেখানো যায়। এবং তবু গতিকে এভাবে ধরলে প্রকৃতির কোন কিছুর সঙ্গেই তা মেলে না : আমরা যখন চকিত স্ন্যাপশটে তাকে ধরি, তার ফলস্বরূপ যে-প্রতিচ্ছবি তৈরি হয়, তা দেখে আমাদের আগে দেখা কোন কিছুর কথাই মনে পড়ে না। সচল গতিকে ধরলে আমাদের কাছে তা তখনই অর্থপূর্ণ যখন তার বর্তমান সংবেদনকে তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সংবেদনের সঙ্গে আমরা বিচ্ছিন্ন করতে পারি না।
যে-কোন বস্তুকে প্রকাশ করার দুটো উপায়; এক তাকে স্থূলভাবে দেখানো, আর-এক শিল্পের মাধ্যমে তার উদ্দীপন। গতির আক্ষরিক উপস্থাপন থেকে নিজেকে সরিয়ে আনলে অধিকতর মহিমা ও সৌন্দর্যে পৌঁছনো যায়। মিশরীয় ভাস্কর্যের দিকে দেখুন : প্রথমে তা দেখে কেমন অনমনীয় কঠিন বলে মনে হয় আমাদের, তবু সেই শরীরের প্রতিরূপেই আমরা গতির সক্ষমতা অনুভব করতে পারি, এবং যা কঠিনতা সত্ত্বেও প্রাণবন্ত। গ্রিক ভাস্কর্যও শান্ত : ডিসকাস ছোঁড়ার মুহূর্তে হয়তো এক ব্যক্তিকে ধরা হয়েছে, যখন সে তার শক্তি সঞ্চয় করছে, অথবা যদি তার সক্রিয়তার সূত্রে তাকে দেখানো হয় খুবই টানটান ও বিপজ্জনক অবস্থায়, তবে ভাস্কর তাকে এমনভাবে সংক্ষিপ্ত ও ঘনসম্বদ্ধ করে এনেছেন যাতে ভারসাম্য পুনঃপ্রতিষ্ঠ হয় এবং এইভাবে সময়ের স্থিতিকাল সম্পর্কেও একটা ধারণা পাওয়া যায়। গতি স্বয়ং অস্থির, এবং ভাস্কর্যের মতো স্থির কোনকিছুর পক্ষে তা মোটেই জুতসই নয়, যদি না শিল্পী এ-বিষয়ে সচেতন থাকেন যে এই সমগ্র গতিসক্রিয়তার একটা মাত্র মুহূর্তই তিনি তুলে ধরছেন।
যে-বস্তু বা যে-অবয়ব আমি আঁকতে চাইছি, আমাকে তার চরিত্র অবিকল যাথার্থ্যে ফুটিয়ে তুলতে হবে। তা করার জন্য আমার পদ্ধতিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করি : শাদা একটা কাগজে যদি আমি একটা কালো বিন্দু দিই, তো অনেক দূরে রাখলেও তা দেখা যাবে : এ হল একটা পরিষ্কার সংকেতলিপি। কিন্তু তার পাশে যদি আর-একটা বিন্দু দিই, তারপর তৃতীয় আর-একটা, তা হলেই সেখানে বিভ্রান্তি তৈরি হবে। অতএব প্রথম বিন্দুটার মূল্য যদি আমি অক্ষুণ্ণ রাখতে চাই তবে আমাকে তা কয়েক গুণ বড় করে আঁকতে হবে।
প্রকৃতিকে আমি ক্রীতদাসের মতো অনুকরণ করতে পারি না, আমাকে তার নতুন ভাষ্য রচনা করতে হবে এবং ছবির মূল অন্তর্বস্তুর কাছে তা সমর্পণ করতে হবে।
শাদা ক্যানভাসে যদি আমি নীল, সবুজ বা লালের কোন সংবেদন সৃষ্টি করতে চাই, তো প্রতিটা নতুন রঙের আঁচড় তার আগের আঁচড়ের গুরুত্ব হ্রাস করবে। ধরা যাক, আমাকে কোন অন্দরমহলের ছবি আঁকতে হবে : আমার সামনে তৈজসপত্র রাখার একটা কাবার্ড রয়েছে, তা আমায় উজ্জ্বল লালের সংবেদন দিচ্ছে, আমি লাল রঙে তা চিত্রিত করে বেশ তৃপ্তি পেলাম। এই লাল এবং ক্যানভাসের শাদার মধ্যে একটা সম্পর্ক স্থাপিত হল। দাঁড়ান, লালের পাশে এবার খানিকটা সবুজ দিই, আর নিচের মেঝেটা হলুদ রঙে রঞ্জিত করি। পুনরায় ঐ সবুজ বা হলুদের সঙ্গে ক্যানভাসের শাদার একটা সম্পর্ক তৈরি হল যা আমায় তৃপ্তি দিল। কিন্তু রঙের এই বিভিন্ন মাত্রা পরস্পরকে দুর্বল করে দেয়। ফলে এই যে রঙের বিভিন্ন আঁচড় আমি ব্যবহার করলাম তার মধ্যে একটা ভারসাম্য আনা দরকার, নইলে তা পরস্পরের ক্ষতি করবে। এ জন্য নিজের ধারণাকে সংহত করতে হবে। রঙের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে সম্পর্ক এমন হওয়া দরকার যাতে তা পরস্পরকে ধারণ করে, ধ্বংস নয়। এই প্রথম ধাপের পর ক্রমে রঙের এক নতুন বিন্যাস রচিত হবে, এবং তা আমার উপস্থাপনার সমগ্রতাকে তুলে ধরবে। আমাকে তখন বাধ্য হয়ে রঙের স্থানান্তর ঘটাতে হবে যতক্ষণ না তাকে সম্পূর্ণ নতুন কোন ছবি বলে মনে হয় এবং বহু অদলবদলের পর সবুজের জায়গায় লাল হয়ে ওঠে প্রধান বর্ণ। প্রকৃতিকে আমি ক্রীতদাসের মতো অনুকরণ করতে পারি না, আমাকে তার নতুন ভাষ্য রচনা করতে হবে এবং ছবির মূল অন্তর্বস্তুর কাছে তা সমর্পণ করতে হবে। রঙের বিভিন্ন মাত্রার মধ্যে যে-সম্পর্ক আমি সেখানে দেখি, তাকে অবশ্যই পরিণত হতে হবে জীবন্ত এক বর্ণসঙ্গতিতে, এমন এক সঙ্গতি যার সঙ্গে মিল আছে সাংগীতিক রচনার।
আমার কাছে এ সবই বোধের বিষয়। ফলে প্রথম থেকেই গোটা জিনিশটা সম্পর্কে আমার একটা পরিষ্কার অন্তর্দৃষ্টি থাকা দরকার। এক মহান ভাস্করের কথা বলতে পারি আমি, যিনি বেশ কিছু প্রশংসনীয় কাজ আমাদের উপহার দিয়েছেন। কিন্তু তাঁর কাছে রচনাবিন্যাস মানে স্রেফ টুকরো-টুকরো অংশকে একত্র করা, ফলে অভিব্যক্তির ক্ষেত্রে একধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়। তার বদলে সেজান-এর কোন ছবির দিকে দেখুন : সবকিছু সেখানে এত সুবিন্যস্ত যে যত দূর থেকেই তা দেখুন, বা যতগুলো অবয়বই সে-ছবিতে চিত্রিত হয়ে থাকুক না কেন, আপনি তার প্রত্যেকটা আলাদা করে বুঝতে পারবেন এবং তাদের কোন্ অঙ্গটা কার তা বুঝতেও কোন অসুবিধে হবে না। ছবিতে যদি শৃঙ্খলা ও স্পষ্টতা থাকে, তার অর্থ হল শুরু থেকেই সেই শৃঙ্খলা ও স্পষ্টতা ছিল শিল্পীর মনে, অথবা এ-দুটি গুণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শিল্পী সচেতন ছিলেন। বিভিন্ন অঙ্গ পরস্পরের সঙ্গে জড়িয়ে থাকতে পারে বা একের ওপর থাকতে পারে আর-একটা অঙ্গ, কিন্তু দর্শকের চোখে তা সঠিক অবয়বের সঙ্গে যুক্ত এবং প্রতিভাত হতে হবে; আর তা হলেই সব বিশৃঙ্খলা দূর হয়ে যাবে।
শরতের নিসর্গ আঁকার সময়ে আমি মনে রাখি না যে কোন্ রঙটা তার সঙ্গে মানানসই হবে, বরং অনুপ্রাণিত হই এই ঋতু আমার ভেতরে যে-সংবেদন জাগিয়ে তোলে তার কথা ভেবে : বিষণ্ণ নীল আকাশের তুষারশুদ্ধতা যেমন এই ঋতুকে প্রকাশ করতে পারে, তেমনই পারে বৃক্ষপত্রের সূক্ষ্ম তারতম্যও।
রঙের প্রধান কাজ হলো অভিব্যক্তিকে যথাসাধ্য সাহায্য করা। কোনরকম পূর্বপরিকল্পনা ছাড়াই আমি রঙ ব্যবহার করি। যদি প্রথমে, হয়তো আমার অচেতনেই, কোন একটা রঙ বা রঙের মাত্রা আমায় প্রলুব্ধ করে বা চেপে ধরে, তবে প্রায় সময়ে ছবি শেষ হওয়ার আগেই তা আমার নজরে পড়ে যে অন্যান্য রঙের অদলবদল বা ক্রমরূপান্তর ঘটালেও ঐ বিশেষ বর্ণাভাকে আমি অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়েছি। রঙের অভিব্যক্তিক দিকটা আমায় প্রভাবিত করে একেবারে সহজাতভাবে। শরতের নিসর্গ আঁকার সময়ে আমি মনে রাখি না যে কোন্ রঙটা তার সঙ্গে মানানসই হবে, বরং অনুপ্রাণিত হই এই ঋতু আমার ভেতরে যে-সংবেদন জাগিয়ে তোলে তার কথা ভেবে : বিষণ্ণ নীল আকাশের তুষারশুদ্ধতা যেমন এই ঋতুকে প্রকাশ করতে পারে, তেমনই পারে বৃক্ষপত্রের সূক্ষ্ম তারতম্যও। আমার সংবেদনও পরিবর্তিত হতে পারে, গ্রীষ্মের ধারাবাহিকতায় তা হতে পারে কোমল ও উষ্ণ, অথবা হতে পারে নিষ্প্রভ আকাশ আর লেবু-হলুদ গাছের পাতায় শীতকালের আগাম ঘোষণা নিয়ে যথেষ্ট হিমশীতল।
তারপর একটা সময় আসে যখন প্রত্যেক অংশ তার সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক খুঁজে পায়, তারপর থেকে সেখানে একটা আঁচড়ও আর যোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, যদি না তা আবার নতুন করে চিত্রিত করার কথা ভাবি।
আমার রঙ নির্বাচন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বনির্ভর নয়; বরং তা পর্যবেক্ষণ, সংবেদনশীলতা ও অনুভূত অভিজ্ঞতা থেকে আহৃত। বর্ণতত্ত্ব নিয়ে দ্যলাক্রোয়া-র লেখা কয়েক পৃষ্ঠা পড়ে সিন্যাক-এর মতো একজন শিল্পী পরিপূরক রঙ নিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন, এবং এই তত্ত্বজ্ঞান তাঁকে বিশেষ জায়গায় বিশেষ রঙ ব্যবহারের দিকে নিয়ে যায়। আমি রঙ ব্যবহার করি নিতান্তই আমার সংবেদনকে রূপ দিতে। রঙের অনুপাতে একটা প্ররোচনার দিক আছে যা কোন অবয়বের আকারে বদল আনতে বা আমার রচনাবিন্যাসকে রূপান্তরের পথে নিয়ে যেতে পারে। সমগ্র রচনার প্রত্যেক অংশে সেই অনুপাতে না পৌঁছনো পর্যন্ত আমি লড়াই করি এবং ততক্ষণ আমি কাজ করে চলি। তারপর একটা সময় আসে যখন প্রত্যেক অংশ তার সুনির্দিষ্ট সম্পর্ক খুঁজে পায়, তারপর থেকে সেখানে একটা আঁচড়ও আর যোগ করা অসম্ভব হয়ে পড়ে, যদি না তা আবার নতুন করে চিত্রিত করার কথা ভাবি।
বাস্তবে, আমি মনে করি পরিপূরক বর্ণের তত্ত্ব কিছু অকাট্য নয়। যে-সমস্ত শিল্পীর বর্ণজ্ঞান সহজাত প্রবণতা ও অনুভূতির ওপর নির্ভরশীল এবং বরাবর নিজেদের সংবেদনের সাদৃশ্যে উদ্ভূত, তাঁদের কাজ পরীক্ষা করে দেখলে রঙের কিছু নিয়ম নির্ধারণ করা যায় এবং এভাবে বর্তমানে প্রচলিত বর্ণতত্ত্বের সীমাবদ্ধতাকে খানিক প্রসারিত করা যায়।
পাদুয়া-য় আমি যখন জিওত্তো-র কোন ফ্রেস্কো দেখি, তখন আমি মোটেই খ্রিস্টের জীবনের কোন্ বিশেষ দৃশ্য সেখানে চিত্রিত করা হয়েছে তা নিয়ে নিজেকে বিব্রত করতে যাই না, কিন্তু সেখান থেকে যে-ভাবের উদয় হচ্ছে তা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি, কারণ তা আছে তার রেখায়, তার রচনাবিন্যাসে, তার রঙে
আমি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ বোধ করি মানুষী অবয়বের প্রতি, স্থিরবস্তুর প্রতি নয়, নয় নিসর্গের প্রতিও। জীবনের প্রতি প্রায় ধর্মীয় সম্ভ্রম প্রকাশ করার তা সুযোগ করে দেয় আমাকে, এবং সবচেয়ে ভালোভাবে। মুখের যাবতীয় অনুপুঙ্খের ওপর আমি তেমন জোর দিই না, একের পর এক নিখুঁত শারীরসংস্থানে তা বিবৃত করার দিকেও নয়। ধরা যাক, কোন ইতালীয় মডেলকে প্রথম দেখে হয়তো তার জৈবিক অস্তিত্ব ছাড়া কিছুই চোখে পড়ে না, তবু আমি তার মৌলিক গুণাবলি ঠিকই আবিষ্কার করি, তার মুখরেখার ভিতরে ঢুকে যাই আমি, যা এক গভীর ভাবের সন্ধান দেয়, এবং যা প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে। কোন শিল্পকর্মকে অবশ্যই নিজের মধ্যে তার সম্পূর্ণ তাৎপর্যকে ধারণ করতে হবে, এবং এমনকী তার বিষয়বস্তু বোঝার আগেই দর্শকের মধ্যে তা চারিয়ে দিতে হবে। পাদুয়া-য় আমি যখন জিওত্তো-র কোন ফ্রেস্কো দেখি, তখন আমি মোটেই খ্রিস্টের জীবনের কোন্ বিশেষ দৃশ্য সেখানে চিত্রিত করা হয়েছে তা নিয়ে নিজেকে বিব্রত করতে যাই না, কিন্তু সেখান থেকে যে-ভাবের উদয় হচ্ছে তা তৎক্ষণাৎ বুঝতে পারি, কারণ তা আছে তার রেখায়, তার রচনাবিন্যাসে, তার রঙে। তার শিরোনাম আমার ধারণাকে নিশ্চিত করে মাত্র।
আমি স্বপ্ন দেখি এক সুষম শিল্পের, স্বপ্ন দেখি শুদ্ধতা ও প্রশান্তির, উদ্বেগ বা বিষাদের কোন বিষয় সেখানে থাকবে না, এমন এক শিল্প যা হবে যে-কোন মানসকর্মীর জন্য, সে হতে পারে ব্যবসায়ী বা সাহিত্যিক, তার মনের গভীরে রচনা করবে স্নিগ্ধতা ও শান্তির আবহ, অনেকটা আরামকেদারার মতো, সারাদিন পরিশ্রমের পর যা বিশ্রামের আনন্দ দেবে।
প্রায়ই কথা ওঠে বিভিন্ন পদ্ধতির মূল্য ও বিভিন্ন মানসপ্রকৃতির সঙ্গে তার সম্পর্ক নিয়ে। যে-শিল্পীরা প্রত্যক্ষভাবে প্রকৃতিকে অনুসরণ করে কাজ করে আর যারা কাজ করে বিশুদ্ধ কল্পনার ওপর নির্ভর করে, তাদের মধ্যে পার্থক্য করা হয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, এই দুই পদ্ধতির কোন একটাকে বাদ দিয়ে আর-একটাকে শ্রেয় মনে করে লাভ নেই। এ দুই-ই ক্রমান্বয়ে একই ব্যক্তি ব্যবহার করতে পারে। কারণ হয় সংবেদন লাভের জন্য বস্তুর সঙ্গে তার যোগাযোগ দরকার যা তার সৃষ্টিশীলতাকে জাগ্রত করবে অথবা তার সংবেদন আগে থেকেই সংগঠিত। উভয় ক্ষেত্রেই তার পক্ষে সেই সম্পূর্ণতায় পৌঁছনো সম্ভব, যা একটা ছবিকে গড়ে তোলে। যে-কোন অবস্থাতেই, আমার মনে হয় সরাসরি প্রকৃতি থেকে তার প্রতীতি গ্রহণ করে বিভিন্ন দিনে মনের একই অবস্থা বজায় রেখে প্রাপ্ত সংবেদনকে সংগঠিত করে যে-শিল্পী কাজ করে যেতে পারে এবং সেই সংবেদনকে আরও বিকশিত করতে পারে, তার প্রাণশক্তি ও ক্ষমতার বিচার করা যায় তার থেকেই, এবং এই ক্ষমতাই প্রমাণ করে যে শৃঙ্খলাধীন হওয়ার মতো যথেষ্ট দক্ষতা তার আছে।
***
এ কথা বিশ্বাস করার মতো তার মনে সেই নম্রতা থাকতে হবে যে আমি যা দেখেছি তা-ই এঁকেছি। শারদ্যাঁ যে-ভাবে বলেছেন এ-নিয়ে, সেটা আমার ভালো লাগে : ‘আমি ততক্ষণ রঙ লাগিয়ে যেতে থাকি যতক্ষণ না সাদৃশ্যে পৌঁছই।’ অথবা সেজান : ‘সাদৃশ্যের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে চাই।’ অথবা রদ্যাঁ : ‘প্রকৃতির অনুকরণ করো!’ লিওনার্দো বলেছেন, ‘যে অনুকরণ করতে পারে সে সৃষ্টিও করতে পারে।’
সেইসব পদ্ধতিই সরলতম, নিজেকে প্রকাশ করতে শিল্পীকে যা সবচেয়ে ভালোভাবে সাহায্য করে। মামুলি বিষয়ে যদি তার ভয় থাকে, তবে উদ্ভট ড্রয়িং আর অদ্ভুত রঙ লাগিয়ে বিচিত্র সেজে সে তা এড়াতে পারে না। তার স্বভাবপ্রকৃতি থেকেই প্রায় আবশ্যিকভাবে তার অভিব্যক্তির উপায় তাকে সংগ্রহ করতে হবে। এ কথা বিশ্বাস করার মতো তার মনে সেই নম্রতা থাকতে হবে যে আমি যা দেখেছি তা-ই এঁকেছি। শারদ্যাঁ যে-ভাবে বলেছেন এ-নিয়ে, সেটা আমার ভালো লাগে : ‘আমি ততক্ষণ রঙ লাগিয়ে যেতে থাকি যতক্ষণ না সাদৃশ্যে পৌঁছই।’ অথবা সেজান : ‘সাদৃশ্যের ব্যাপারে আমি নিশ্চিত হতে চাই।’ অথবা রদ্যাঁ : ‘প্রকৃতির অনুকরণ করো!’ লিওনার্দো বলেছেন, ‘যে অনুকরণ করতে পারে সে সৃষ্টিও করতে পারে।’ প্রকৃতি থেকে ইচ্ছে করে মুখ ঘুরিয়ে যারা পূর্বধারণার বশে কোনো বিশেষ শৈলীতে কাজ করে, তারা সত্যের নাগাল পায় না। শিল্পীকে যুক্তি দিয়ে এ-কথা বুঝতে হবে যে তার ছবি একটা নির্মাণ মাত্র; কিন্তু সে যখন ছবি আঁকছে তাকে অনুভব করতে হবে যে সে আসলে প্রকৃতির অনুকরণ করছে। এমনকী যখন সে তার থেকে বিচ্যুত হচ্ছে, তখনও এই বিশ্বাসে সেখান থেকে সরতে হবে যে প্রকৃতিকে আরও সম্পূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করার জন্যই সে তা করছে।
কেউ-কেউ বলতে পারেন যে একজন চিত্রকরের কাছ থেকে তাঁরা অন্যরকম কিছু আশা করেছিলেন, আর আমি শুধু মামুলি কথাই বললাম। এ-কথার উত্তরে আমি বলতে পারি যে নতুনতর সত্য বলে কিছু নেই।
কেউ-কেউ বলতে পারেন যে একজন চিত্রকরের কাছ থেকে তাঁরা অন্যরকম কিছু আশা করেছিলেন, আর আমি শুধু মামুলি কথাই বললাম। এ-কথার উত্তরে আমি বলতে পারি যে নতুনতর সত্য বলে কিছু নেই। পণ্ডিতদের মতো শিল্পীরও কাজ হল তার কানের কাছে বারবার বলা বর্তমানের সত্যকেই আয়ত্ত করা, কিন্তু তার কাছে তা নতুন কোন অর্থ নিয়ে আসে, এবং যখন সে তার গভীরতর তাৎপর্য উপলব্ধি করে তখন সে তাকে নিজের করে নেয়। কোন বৈমানিককে যদি পৃথিবী ছেড়ে আকাশে ওড়া নিয়ে বিবিধ গবেষণার কথা ব্যাখ্যা করতে হয়, তবে পদার্থবিদ্যার প্রাথমিক কিছু নীতির কথাই সে বলবে, তুলনায় অসফল আবিষ্কারকেরা যা অবহেলা করেছে।
একজন শিল্পী নিজের সম্পর্কে যত কথা জানবে তত লাভ, আমি খুশি যে এভাবে আমি আমার দুর্বলতার দিকগুলোকে চিনতে পেরেছি। মঁস্যিয় পেলাদাঁ ‘রেভু এবদোমাদ্যার’-এ কয়েকজন শিল্পীর নিন্দা করেছেন, যার মধ্যে মনে হয় আমারও নিজেকে রাখা উচিত। তিনি বলেছেন, এরা নিজেদের ‘ফ্যভ’ বলে, কিন্তু পোশাক পরে সাধারণ লোকের মতো, ফলে ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের কোনো কর্মকর্তার থেকে তাদের আলাদা করা যায় না। এত অল্পেই প্রতিভা চেনা যায়? এ যদি শুধু আমার কথা হত, তবে মঁস্যিয় পেলাদাঁ নিশ্চিন্ত হতে পারেন যে কাল থেকে আমি প্রেতসিদ্ধের মতো পোশাক পরব আর নিজেকে উপযুক্ত কোন নামে ডাকব।
ঐ একই লেখায় এই দুর্দান্ত লেখক দাবি করেছেন যে আমি সততার সঙ্গে আঁকি না, সঙ্গত কারণেই আমি ক্রোধান্বিত হতে পারতাম যদি না তিনি তাঁর এই বিবৃতিকে বিশদ করতেন এইভাবে : ‘সততার সঙ্গে কথাটা আমি আদর্শ ও বিধিনিয়মের সূত্রে বলছি।’ মুশকিল হল, তিনি জানাননি যে ঐ সব বিধিনিয়ম আছে কোথায়। আমি চাই যে তারা থাকুক, কিন্তু আমাদের মহান শিল্পীদের কাছ থেকে কি তা শেখা সম্ভব!
কারণ আমরা চাই বা না চাই, আমরা এই সময়ের সন্তান, এবং তার মতামত, তার অনুভব, এমনকী তার বিভ্রমেরও অংশী। যে-কোন শিল্পীই সময়ের এই ছাপ বহন করে, কিন্তু মহৎ শিল্পী তাঁরাই যাঁদের মধ্যে তা সবচেয়ে গভীরভাবে চিহ্নিত।
ব্যক্তির বাইরে নিয়মের কোন অস্তিত্ব নেই : নইলে যে-কোনো ভালো অধ্যাপকই রাসিন-এর মতো প্রতিভাবান হতেন। আমাদের মধ্যে যে-কেউ ভালো-ভালো প্রবচন আওড়াতে পারে, কিন্তু তাদের মধ্যে অল্প কয়েকজন তার অর্থভেদও করতে পারে। এ-কথা স্বীকার করছি যে মানে বা রেনোয়ার-এর চেয়ে রাফায়েল বা তিশিয়ান-এর কাজ ভালোভাবে পাঠ করে অনেক পূর্ণাঙ্গ এক প্রস্থ বিধিনিয়ম তৈরি করা যেতে পারে, কিন্তু মানে বা রেনোয়া সেইসব নিয়মই অনুসরণ করেছেন যা তাঁদের স্বভাবপ্রকৃতির সঙ্গে মানানসই, এবং যারা খালি ‘ভিনাস অফ উরবিনো’ বা ‘মাডোনা অফ দ্য গোল্ডফিঞ্চ’-এর অনুকরণ করেই সন্তুষ্ট তাদের চেয়ে মানে বা রেনোয়া-র যে-কোনো ছোটখাটো কাজকেও আমি সবসময় বেশি গুরুত্ব দেব। এই ভিনাস বা মাডোনা আঁকিয়েদের কারও কাছেই কোন গুরুত্ব নেই, কারণ আমরা চাই বা না চাই, আমরা এই সময়ের সন্তান, এবং তার মতামত, তার অনুভব, এমনকী তার বিভ্রমেরও অংশী। যে-কোন শিল্পীই সময়ের এই ছাপ বহন করে, কিন্তু মহৎ শিল্পী তাঁরাই যাঁদের মধ্যে তা সবচেয়ে গভীরভাবে চিহ্নিত। আমাদের যুগ যেমন (জাঁ-ইপোলিত) ফ্লঁদ্রাঁ-র চেয়ে (গুস্তাব) কুর্বে-র কাজে, (এমানুয়েল) ফ্রেমিয়ে-র চেয়ে (অগুস্ত) রদ্যাঁ-র কাজে অনেক ভালোভাবে উপস্থাপিত। আমরা তা পছন্দ করি বা না করি, কিংবা যত জোরের সঙ্গেই নিজেদের আমরা নির্বাসিত বলি না কেন, আমাদের যুগ ও আমাদের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন প্রতিষ্ঠিত, এমনকী মঁস্যিয় পেলাদ্যাঁ-ও তার থেকে মুক্ত নন। ভবিষ্যতের নন্দনতাত্ত্বিকরা যদি তার এক কপি হাতে পায় তবে হয়তো তাঁর বইকে সাক্ষ্য হিসেবে ব্যবহার করবে এ-কথা প্রমাণ করতে যে আমাদের সময়ের একজনও লিওনার্দো দা ভিঞ্চি-র শিল্পকর্মের এক কণাও বোঝেনি।
(লা গ্রঁদ রেভ্যু, ডিসেম্বর ১৯০৮)