প্রথম পাতা চিত্রশালা ধূসর দিনের ছবি

ধূসর দিনের ছবি

0

পা‍র্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা, থানছি ও নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় বাস করেন ম্রোরা। থাকেন পাহাড়ে মাচাং বানিয়ে। ঘর ও ঘরের যাবতীয় জিনিশপত্র নিজেরাই তৈরি করে নেন। কেউ মাচাং তৈরি করতে উদ্যোগ নিলে প্রতিবেশীরা এগিয়ে এসে হাত লাগান স্বতঃস্ফূ‍র্তভাবে। তাঁরা সাধারণত বাজারনি‍র্ভর নন। নেহাত কেরোসিন তেল, তামাক, মাছ, কাপড়, ছাতা ইত্যাদি ছাড়া তাঁরা নিজেদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও হাতিয়ার প্রকৃতি থেকেই জোগাড় করে নিতে পারেন। মেয়েরা নিজেদের পরনের থামি নিজেরাই বোনেন। স্বভাবত ম্রোরা অন্ত‍‍র্মুখী ও লাজুক। চুপচাপ কাজে মগ্ন থাকেন, এমনকী বাচ্চারাও খেলতে গিয়ে চেঁচামেচি বা মারামারি করছে বলে কখনও দেখা যায় না। ভোর থেকে সন্ধ্যা প‍‍র্যন্ত ম্রোরা জুমচাষ ও অন্যান্য গেরস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকেন। 

ম্রোরা সারাবছর টাকাপয়সা জমিয়ে রাখেন ‘চাংক্রান পই’ বা নবব‍‍‍র্ষের উৎসবে কেনাকাটার জন্য। চৈত্রসংক্রান্তি ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষ্যে এই উৎসব হয়ে থাকে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝিতে। ম্রো ছেলেবুড়ো তরুণ-তরুণী সবাই এসময় চমৎকার সাজপোশাক ও অলংকারে সুশোভিত থাকেন। হাটবারে সেজেগুজে দল বেঁধে বাজারে যাওয়া ম্রোদের বিনোদনের অন্যতম উপায় মনে হয়।  

‘চিয়াসদ পই’ বা গোহত্যা-উৎসব ম্রোদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব। হত্যা বা উৎস‍‍র্গের জন্য একটি গরুকে উঠোনে ঘিরে রাখা হয় বিশেষভাবে বানানো বাঁশের বেড়ায়। এসময় ম্রো যুবক-বৃদ্ধরা মদ্যপান করেন, ‘প্লুং’ বা বাঁশির সুরে-সুরে শিশু ও অবিবাহিত কিশোরীরা বৃত্তাকারে নাচতে থাকে। এই বাঁশি ম্রোদের নিজস্ব বাদ্যযন্ত্র। উৎসব ছাড়াও ম্রোদের এই বাঁশি বাজাতে দেখা যায় ঘরে, বাজারে, জুমচাষের সময় জুমঘরে।

আদিতে প্রকৃতিপূজারি থাকলেও অধিকাংশ ম্রো এখন বৌদ্ধধ‍‍র্মবিশ্বাসী, অনেকেই খ্রিষ্টানধ‍‍র্মে দীক্ষিত। আশির দশকে মেনলে ম্রো (জ. ১৯৬৫)-প্রব‍‍র্তিত ক্রামাধ‍‍র্মেও দীক্ষিত হয়েছেন অনেক ম্রো। মেনলে ম্রো ম্রো ব‍‍র্ণমালারও আবিষ্ক‍‍র্তা। তাঁর মতে, ‘চিয়াসদ পই’ বা গোহত্যা-উৎসবের আর প্রয়োজন নেই। কারণ ঈশ্বরপ্রেরিত যে-ধ‍‍র্মগ্রন্থ বা ব‍‍র্ণমালা খেয়ে ফেলার অপরাধে নিরীহ গরুকে বধ করা হতো, সেই ধ‍‍র্মগ্রন্থ বা ব‍‍‍র্ণমালা এখন ম্রোদের হাতে এসে গেছে। ধ‍‍র্মান্তরের কারণেও নানাবিধ পরিব‍‍র্তন এসেছে ম্রোদের জীবনযাপনে।

নব্বইয়ের দশকে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, বিশেষত ম্রোদের ছবি তুলতাম একটি সেকন্ড-হ্যান্ড ক্যামেরায়। সে-সময় ৩৫ মিলিমিটার ফরমেটের ফুজি কালার ফিল্মের প্রচলন ছিল বেশি। বান্দরবানের অপরূপ নৈস‍‍র্গিক শোভা, ম্রোদের সাধারণ দৈনন্দিন জীবনযাপন, গেরস্থালি, পারিবারিক বন্ধন, দল বেঁধে বাজারে যাওয়া, কেনাকাটা, নৌকায় ঘরে ফেরা, ‘চিয়াসদ পই’ বা গোহত্যা-উৎসবে আনন্দোচ্ছ্বাস, সামাজিক ও ধ‍‍র্মীয় রীতিনীতি, তন্ত্রমন্ত্র বা সংস্কার প্রভৃতি নানা বিষয় ধরে রাখতে চেয়েছি আমার পুরোনো দিনের ক্যামেরায় ফিল্মে-তোলা ছবিতে। এখনও ম্রোদের গ্রামে ছবি তুলতে যাই, কিন্তু যে-সময় ফেলে এসেছি কয়েক দশক পেছনে সে-সময়ের প্রকৃতি, আবহ, বিষয়বন্তু, চেহারা ও রং হুবহু তেমন নেই আর। চলতি হাওয়ায় আরও কিছু পরিব‍‍র্তনের আগে একপলক দেখে নেওয়া যেতে পারে ধূসর দিনের ছবিগুলো।

কোন মন্তব্য নেই

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

Exit mobile version