উৎসর্গ : বাংলাদেশের প্রণম্য আলোকচিত্রীদের, রানা প্লাজা গণহত্যাকে যারা নানাভাবে বন্দি করেছেন ক্যামেরায়। ইমেজের রাজনীতি আর মালিকানার তর্কের তল যারা ক্রমাগত প্রসারিত করেছেন।
দুমড়ানো মেঘের ছায়া ঘাড়ে নিয়ে সবেমাত্র সকালের চোখ মেলছে এক ছিমছাম শহর, রাজশাহী। খুঁজে পেতে সময় নিল না, জায়গাটি শহরের প্রান্তে, ‘খ্রিষ্টান পাড়া’ নামে চেনে বাইরের লোকজন। নিজেরা বলেন, ‘আদিবাসী পাড়া’। কীভাবে যেন জায়গাখানি সেনানিবাসের হয়েছে, একটা কলোনি হিসেবে জায়গা মিলেছে আদিবাসীদের। পাড়ায় ঢুকতেই ঘেরাও দেয়ালে লেখা আছে, ‘কয়েরদাড়া কলিমনগর খ্রিষ্টান পাড়া’। পাড়ার ভেতরে এক মধ্যবয়সী বটগাছের তলায় ছোট জটলা, পাশেই বিদ্যালয়। জটলার কিনারে দাঁড়িয়ে জানতে চাই, ‘মার্থা শিখা হাঁসদার বাড়িটা কোনদিকে?’ জটলা থেকে নানা উত্তর আসে।
‘সামনে এগিয়ে যান, বামে শিখাদের ঘর’
‘রানা প্লাজায় মরছিল’
‘ঢাকায় গিয়া হারাইছে’
চারদিকে একটা বেড়া আছে, ছোট্ট উঠান, সেখানেই রান্নাঘর। উঠান পেরিয়ে ঘর, একটা খাট, ছোট্ট টেবিল আর প্লাস্টিকের চেয়ার। দেয়ালে সাঁটানো ‘মঙ্গলময় প্রভু যিশুর পোস্টার’, জং ধরা পেরেকে ঝুলছে কয়েকটি সস্তা তামার মেডেল আর কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই করা শিখার একটি রঙিন ছবি। শিখার মা কসতানন্তিনা হাঁসদা পত্রপত্রিকার নানা খবর, নথি সব মেলে ধরলেন বিছানায়। মুহূর্তেই বিছানার ফুললতাপাতারা ঢেকে গেল এক নিদারুণ ঘটনার নথির বিবরণে। শিখার ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে, হদিশ মিলেছে। লাশ পায়নি পরিবার, কিন্তু তার যে মরণ হয়েছে এটিও তো একটি হদিশ। ২০১৩ সনের ২৪ এপ্রিল ঢাকার সাভারের রানা প্লাজায় খুন হন গার্মেন্টস শ্রমিক শিখা। পেঁপেতুয়া হাঁসদা ও শেফালী মার্ডীও শিখার মতন অগণিতের ‘মৃত্যুর’ চিরকুটে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। মার্থা শিখা হাঁসদা জাতিতে মাহালী। মা কসতানন্তিনা ও বাবা রেনাতুশ হাঁসদা। রাজশাহীর দামকুড়াহাটে বসতি হলেও সেখান থেকে উচ্ছেদ হয়ে তাদের পরিবার চলে আসে কয়েরদাড়া কলিমনগর খ্রিষ্টান পাড়ায়। আটকুশি উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন শিখা। দিনাজপুরের সুইহারীতে ‘নভেরা টেকনিক্যাল স্কুলে’ ২০১২ সনে গার্মেন্টস সেলাই প্রশিক্ষণ নেন। তারপর ২০১৩ সনে সাভারের রানা প্লাজায় জুনিয়র সুইং অপারেটর হিসেবে যোগ দেন। পেঁপেতুয়া হাঁসদা ও শেফালী মার্ডী জাতিতে সাঁওতাল। পেঁপেতুয়ার বাড়ি দিনাজপুরের বিরলের শাইখডাঙা। মায়ের নাম চিচিলিয়া মুর্মু ও বাবা রাফায়েল হাঁসদা। শেফালী মার্ডীর বাড়িও দিনাজপুর সদরের ভাটপাড়ায়। শেফালীর মা আগ্নেশ হাঁসদা ও বাবা স্যামুয়েল মার্ডী। এরা সকলেই রানা প্লাজায় জুনিয়র সুইং অপারেট হিসেবে কাজ করতেন। শিখাদের ঘরের দেয়ালে টানানো ফ্রেমবন্দি তার একটি রঙিন ছবি আর বিছানাভর্তি নানা নথি আমাকে এক ঘোরের ভেতর ধাক্কা দেয়। ছবি কী কোনো নথি না সাক্ষ্য? শিখার মা জানান, শিখার আরও ছবি ছিল, আমাদের কাছে নেই, হারিয়ে গেছে।
জলে ডুবিয়ে বিস্কুট খেতে খেতে জানতে চাই, হারাল কেন?
‘শিখা সাথে করে নিয়ে গিয়েছিল। একবার তারা স্মৃতিপার্কে (জাতীয় স্মৃতিসৌধ) গিয়েছিল, ফুলবাগানের ছবি ছিল। ও গান জানতো, অভিনয় জানতো, কত পুরস্কার আর মেডেল পেয়েছে’
বিছানাময় পত্রিকা দেখিয়ে বলি, এই যে রানা প্লাজার এত এত ছবি, এখানেই তো শিখা…।
বিছানা থেকে চোখ ঘুরিয়ে শিখার মা দেয়ালের দিকে তাকান, কী জানি কার ছবি!
টুপটাপ বাতাসে স্পষ্ট হয় দম আটকানো দীর্ঘায়িত এক নিরুদ্দেশ।
ফিরতি পথে শুরু হয় চৈত্রের তুফান। হুলস্থুল হয়ে উঠে শহর। ধূলি আর বাতাসের ঝাপটা। রিকশা ছেড়ে দৌড়ে ঢুকি পয়মন্ত এক টং ঘরে। চারধারে লাল পলিথিন বাঁধা হচ্ছে। যেন জলে না ভিজে যায় পাউরুটি, কেক, চায়ের কেটলি কী টাকার ডিব্বা। বাতাসের তাপে আগুনের ঝাঁঝ কম, জটলা ধরে মূলত বাঙালি পুরুষের গুমগুম।
‘হরতালে পুলিশ মারছে, ছবি দেখাইছে’।
‘মাসটাই গেল কোনো কাম কাজ নাই, কতদিন চলবো এইগুলা’
‘দেখেন কেমন লাল আগুন জ্বলছে, টায়ার পুড়াইছে, কালা ধুমা বাইর হইছে’
‘আরে পত্রিকাঅলারা এইগুলা বানাইয়া বানাইয়া দেয়, কম্পিটারে ছবি বানায়, একটু হইলে আরেকটু দেখায়’
বাতাসের ঝকমারি ঝিম মারে। আবারো রাস্তায় রিকশায় দৌড়। রাস্তার খন্দে জমে থাকা জলে হঠাৎ পা পিছলে যায়। জলে ভেজা ক্ষয়াটে জুতার সেলাই আলগা হয়ে যায়। ছেঁড়া সেলাই গিঁট দিয়ে আটকে ঘাড় উঁচু করতেই একটা সিমেন্ট কোম্পানির বিলবোর্ড। কোম্পানিটি রানা প্লাজা গণহত্যার একটি আলোকচিত্র ব্যবহার করেছে। দুমড়ানো মুচড়ানো রানা প্লাজা। কোম্পানিটি বলছে, তাদের সিমেন্ট ব্যবহার করলে রানা প্লাজার মতো ‘বিপর্যয়’ ঘটবে না। সন্ধ্যারাতের ঝিম এড়িয়ে একটা ভিড়ের ভেতর ঢুকে যাই। ছেঁড়া জুতার তলায় আটকে আছে এক জং ধরা পেরেক।
পেরেকটি এবার খুলতে হবে।
ইমেজ স্মৃতিস্মারক না ঘটনার নিবন্ধন? মুহূর্তের নথি না বানানো মুহূর্ত? এই ইমেজের উপস্থাপন কার চোখে নথিবদ্ধ হয়? ব্যক্তির সমাজ-রাজনৈকিতার তল থেকে না এ-শুধুই যন্ত্রের কারিগরি মাত্র।
চলতি আলাপখানি কোনও পেরেক খোলা নিয়ে নয়। ইমেজের রাজনীতি নিয়ে একটা খুব আপাত নিরীহ আলাপের খসড়া ভূমিকা। আমাদের সমকালীন আলোকচিত্রে রানা প্লাজা গণহত্যা একটা ডাকসাইটে জায়গা নিয়ে সামিল আছে। দশাসই ও দুর্ধর্ষ। রানা প্লাজা নিয়ে এক বৃহৎ আলোকচিত্র-ময়দানকে চলতি লেখাটি পাঠ করছে না। করবার মতন এক বিঘত গর্দানও চলতি আলাপখানির নাই। রানা প্লাজা নিয়ে কতজন আলোকচিত্রী কতভাবে কাজ করেছেন সে হদিশ আমার ধারে নাই। যেসব আলোকচিত্র চারধারে একটা শোরগোল তুলেছে, বৈশ্বিক তর্ক তুলেছে সেসবের তুলনামূলক কোনো বিশ্লেষণও এখানে থাকছে না। আলাপখানি মূলত রানা প্লাজাকে ঘিরে তৈরি হওয়া দৃশ্যমানতার রাজনৈতিকতাকে পাঠ করতে চেয়েছে। প্রণম্য তাসলিমা আখতার, আবীর আবদুল্লাহ, রাহুল তালুকদার, এন্ড্রু বিরাজ থেকে শুরু করে আসমুদ্রহিমাচল। জানি প্রতিজনেরই বয়ান, ভঙ্গিমা, মনস্তত্ব, পরিবেশরীতি ও রাজনৈতিকার দরবারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যঞ্জনা ও কারিগরি আছে। এসব কারিগরি কোনোভাবেই সমান্তরাল, সরল, বক্র, বৃত্তাকার, কৌণিক শুধুমাত্র নয়। চলতি আলাপখানির ইমেজ-রাজনৈতিকতার প্রশ্নটি মূলত: রানা প্লাজায় গণহত্যায় নিহত শ্রমিক মার্থা শিখা হাঁসদার মা আর রাস্তার কিছু জটলা থেকে ধার করা। ইমেজ স্মৃতিস্মারক না ঘটনার নিবন্ধন? মুহূর্তের নথি না বানানো মুহূর্ত? এই ইমেজের উপস্থাপন কার চোখে নথিবদ্ধ হয়? ব্যক্তির সমাজ-রাজনৈকিতার তল থেকে না এ-শুধুই যন্ত্রের কারিগরি মাত্র। ইমেজের উপস্থাপনে ক্ষমতা ও শ্রেণিপ্রশ্ন কীভাবে চুরমার হয় বা তলিয়ে যায়, নাকি ইমেজ তৈরি হয় ব্যক্তির দরবার ও বুদবুদের ফেনায়। রানা প্লাজার ইমেজ আমাদের মূলত কী জানান দেয়? রাষ্ট্র ও করপোরেট এজেন্সির ব্যর্থতা? নয়াউদারবাদী চক্রান্ত? ব্যক্তি পর্যায়ের দুর্নীতি ও সাংগঠনিক রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন? নির্মাণ জালিয়াতি নাকি বিচারহীনতার সংস্কৃতি? চলতি আলাপে রানা প্লাজার আলোকচিত্রকে কেন্দ্রে রেখে ইমেজের রাজনীতি ও মালিকানা পাঠের এক দুঃসাহস করি আসুন, একসাথে।
গণহত্যার আলোকচিত্র পরিবেশন
পেগামারি, দাইরসা, লোগাং, লংগদু, নানিয়ার চর থেকে শুরু করে মুলুকযাত্রী চা-শ্রমিক গণহত্যার প্রসঙ্গ টানছি না। কারণ অধিপতি ইতিহাস-গ্রন্থনের প্রবল চাপ ও চিহ্নিতকরণের কায়দা ওইসব গণহত্যাকে নির্দয়ভাবে আড়াল করে দিয়েছে। রাষ্ট্রের ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধই গণহত্যার একমাত্র নজির। অন্যসব গণহত্যা সচরাচর ‘দুর্ঘটনা’, ‘সহিংসতা’, ‘সংঘাত’ হিসেবেই পরিবেশন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যাকে আমরা আলোকচিত্র পরিবেশনায় কীভাবে দেখে এসেছি? গরিষ্ঠভাগই নির্দয় চুরমার ও গলিত রক্তস্রোতে। প্রশ্ন উঠতে পারে মুক্তিযুদ্ধ কী নির্দয় চুরমার আর গলিত রক্তস্রোতের আখ্যান নয়? অবশ্যই। একইসাথে তা আত্মপরিচয় ও সার্বভৌমত্বের এক জীবনজয়ী জনবীক্ষাও। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা-আলোকচিত্রে সেই জীবনজয়ী জনবীক্ষার জায়গা কোথায়? তার মানে কী গণহত্যার সেইসব ইমেজ-বিবরণ দলিত চুরমার আর গলিত রক্তস্রোতের নমুনা দলিল। যাকে বলা হয় ‘বাস্তবতার নথিভুক্তকরণ’। তার মানে আলোকচিত্র কী শুধুই যন্ত্রের কারিগরিতে পরিবেশিত নথিভুক্ত বাস্তবতা? ইমেজ কী শুধুই কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ? তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক ইমেজ কী সাক্ষ্য দেয়? কোনও বাস্তবতাকে কীভাবে ধারণ করে? কীভাবে উপস্থাপন ও পরিবেশ করে? কার চোখে এই বাস্তবতা নথিভুক্ত হয়ে ওঠে? সমাজে বিদ্যমান ক্ষমতার ধারা কী এই বাস্তবতাকে সাক্ষ্য প্রমাণ হিসেবে অনিবার্য করে তুলে? বা কখনো আড়াল করে দেয় বা কখনো চূড়ান্তভাবে খারিজ করে? মুক্তিযুদ্ধ গণহত্যাসহ কোনও গণহত্যার আলোকচিত্র উপস্থাপনের সাথেই কারো তুলনা করা হচ্ছে না। গণহত্যার ইমেজ-রাজনৈতিকতাকে বুঝতে চলতি আলাপে এই রক্তস্মরণ যুক্ত হয়েছে।
বিশ শতকে এসে বাংলাদেশের আলোকচিত্র এক নয়াযাত্রা শুরু করে এবং দেখা যায় আলোকচিত্রের বিষয় ও পরিবেশনায় চলমান রাজনৈতিক নানা দরবার হাজির হতে থাকে। রাষ্ট্র থেকে বৈশ্বিক। এ-সময়টাতে আরেকটি গুরুত্ববহ ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশি আলোকচিত্রী এবং বাংলাদেশের আলোকচিত্র নানা বৈশ্বিক পুরস্কার জিততে থাকে। নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভরে যেতে থাকে বাংলাদেশি আলোকচিত্রীর তাক।
আমি আলোকচিত্রকে যাপিত জীবনের আন্তঃনির্ভর স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে দেখি। বাংলাদেশের আলোকচিত্র ইতিহাসে দেখা যায় এখানে গুরুত্বপূর্ণভাবে পরিবেশন-রাজনীতির এক স্ফূরণ ঘটেছে। ‘বাংলাদেশের আলোকচিত্র’ বরাতে চলতি আলাপ বাংলাদেশকে ঘিরে বাংলাদেশি আলোকচিত্রীর কাজকেই বুঝতে চেয়েছে। এর সাথে কোনোভাবেই জাতীয়তাবাদী তর্কের সম্পর্ক নাই। আশির দশক অব্দি বাংলাদেশের আলোকচিত্রে যন্ত্রনির্ভর কারিগরি, বিষয়ের বহুমাত্রিক বিশ্লেষণ ও পরিবেশনার ধরণে খুব একটা তর্কের বৈচিত্র্য ও নিরীক্ষাধরণ তৈরি হয়নি। কিন্তু নব্বই দশকে আলোকচিত্রে এক বহুমাত্রিক বিস্তার তৈরি হয়। বিষয়বিন্যাস থেকে শুরু করে যন্ত্রনির্ভর কারিগরি, নানা ধরণের নিরীক্ষা, শিল্পমাধ্যম হিসেবে চর্চা, নানা তর্ক বাহাসের সম্মিলন, উপস্থাপন ও পরিবেশনায় বৈচিত্র্য সব মিলিয়ে আলোকচিত্র যাপিত জীবনের এক কার্যকর তল হিসেবে বিকশিত হওয়ার চেষ্টা করেছে। ব্যক্তি আলোকচিত্রী থেকে আলোকচিত্রের কিছু সংগঠন ও বিদ্যালয়ের প্রভাবও এখানে গুরুত্বপূর্ণ সঞ্জিবনী তৈরি করেছে। এর সাথে আলোকচিত্র ঘিরে বিশ্বায়িত বাজার, ক্যামেরা ও উপকরণের প্রসারিত বাণিজ্য এবং ভার্চুয়াল বাহাদুরির সম্পর্ক আছে কী না তা চলতি আলাপের বিষয় নয়। বিশ শতকে এসে বাংলাদেশের আলোকচিত্র এক নয়াযাত্রা শুরু করে এবং দেখা যায় আলোকচিত্রের বিষয় ও পরিবেশনায় চলমান রাজনৈতিক নানা দরবার হাজির হতে থাকে। রাষ্ট্র থেকে বৈশ্বিক। এ-সময়টাতে আরেকটি গুরুত্ববহ ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশি আলোকচিত্রী এবং বাংলাদেশের আলোকচিত্র নানা বৈশ্বিক পুরস্কার জিততে থাকে। নানা আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভরে যেতে থাকে বাংলাদেশি আলোকচিত্রীর তাক। একটা বড় সময় জুড়ে বাংলাদেশের আলোকচিত্র পোর্ট্রেট, প্রকৃতি আর দেশের দারিদ্র্য-যন্ত্রণার কঙ্কাল খুঁজে ফিরলেও বিশ শতকে এসে এই পরিবেশনার ধরণটি পাল্টে যেতে থাকে। আলোকচিত্রের বিষয় হয়ে ওঠে আদিবাসী জীবন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, হিজড়া, বেশ্যা, সম্পর্কের নানা ধরণ, রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, লিঙ্গীয় দরবার, নারী, বন্যা ও নদীভাঙ্গন, জনআন্দোলন, বস্তিবাসী, শ্রমিক, অভিবাসী, সামাজিক অন্যায়সহ কিছু পরিবেশগত প্রশ্ন। দেখা যায় এ-সময়টাতে দারিদ্র্য-যন্ত্রণা না খুঁজলেও কথিত সচেতন ও সংবেদনশীল ক্যামেরা বারবার তন্নতন্ন করে খুঁজেছে ‘প্রান্তিকতা’। আর এই প্রান্তিকতা-সন্ধানী ক্যামেরা ইমেজের পর ইমেজের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের আলোকচিত্রের এক ডিসকোর্সকেও হাজির করছে জোরদার কায়দা। এসব ইমেজের বড় অংশ জুড়ে পরিবেশিত হয়েছে ‘অন্যতা’। অন্যতাকে পাঠের নানা বাহাস থাকলেও বাংলাদেশের আলোকচিত্রে এক বড় অংশ জুড়ে ‘অন্যতার’ পরিবেশন ঘটেছে এক নির্দয় উপনিবেশিক কায়দাতেই। এখনো তা ঘটেই চলেছে। তাহলে যন্ত্র হিসেবে ক্যামেরা কী উপনিবেশিক মনস্তত্ব ধারণ করে? ক্যামেরার লেন্স, ফোকাস করার কারিগরি বা অন্যান্য কিছু। ক্যামেরার মালিকের মনস্তত্বই ক্যামেরার মন। ক্যামেরার ভেতর দিয়ে একজন আলোকচিত্রীই কোনো বাস্তবতাকে তার নিজের পাঠপ্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে নির্মাণ বা বিনির্মাণ করেন। অন্য বা ভিন্ন সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতি যারপরনাই উপনিবেশিক আগ্রহের এক প্রবলস্রোতে বহন করে চলেছে আমাদের ইমেজের মন ও শরীর। আর তাই আমাদের ক্যামেরা এক সময় ঝাঁপিয়ে পড়েছে অভাবি জনপদে, সব ধরণের রাজনৈতিক দরবার আড়াল করে পরিবেশন করেছে মানুষের শরীর। দেখাতে চেয়েছে বাংলাদেশের অভাবক্লিষ্ট মুখ। এসব আলোকচিত্রের বেশ আন্তজার্তিক চাহিদা ছিল একটা সময়। বাজার বদলেছে, চাহিদা ও চিন্তারও বদল ঘটেছে। ক্যামেরার বাহাদুরি তাই ঝাঁপিয়ে পড়েছে বেশ্যালয়ে, আদিবাসী জনপদে ঘুম কি গোসলের ভেতর, হিজড়া কি হরতালে। অন্যায্যতা আর সংকট পরিবেশনই যেন বাংলাদেশের ইমেজের সাম্প্রতিক প্রকাশ। নিম্নবর্গের সংগ্রাম ও সম্পর্কের ঐতিহাসিকতা যেখানে কোনোভাবেই মূল অংশ হিসেবে পরিবেশিত নয়। ইমেজের এই সাম্প্রতিক তল খুব সচেতনভাবে বাস্তবতার সাক্ষ্য-প্রমাণের মোড়ক ছুঁড়ে ফেলে নিজেই বাস্তবতাকে নিয়ন্ত্রণের বাহাদুরি রপ্ত করে চলেছে। অবশ্যই বাস্তবতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে, অনেকক্ষেত্রে হয়েছে বিদ্ধ। দেখা গেছে, আন্তর্জাতিক বাজার এবং পশ্চিমা বিদ্যায়তনিক তর্কের ময়দান ইমেজকে যেভাবে দেখতে চেয়েছে একটা বড় সময় জুড়ে বাংলাদেশের আলোকচিত্র সেই মনস্তত্ত্বই ধারণ করেছে। উপনিবেশিকতার প্রবল লেন্সের ভেতর দিয়ে ফোকাস হয়েছে বাংলাদেশর নিম্নবর্গের জীবন। এক প্রবল বাঙালি শহুরে এলিট-ধলা-ধনী পুরুষের ভিন্নতার মন ও অন্যতার শরীরে। কখনো কখনো তা দুর্ধর্ষ ও লুটেরা। বাংলাদেশের আলোকচিত্র-ডিসকোর্স রানা প্লাজার ইমেজকে কীভাবে দাঁড় করিয়েছে আলাপের বিস্তারকে আমরা এখন সেখানে টেনে নিচ্ছি।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বিসিক শিল্পনগরীতে ১৯৭৭ সনের ২৭ ডিসেম্বর গড়ে ওঠে বাংলাদেশের প্রথম গার্মেন্টস কারখানা ‘দেশ গার্মেন্টস লিমিটেড’। বাংলাদেশ থেকে তৈরি পোশাক রপ্তানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৭৬-১৯৭৭ সনে। দেশে বর্তমানে ৪৪ লাখ মানুষ গার্মেন্টস শিল্পে এবং ৮০ লাখ টেক্সটাইল খাতে কাজ করে। কিন্তু আলোকচিত্র গার্মেন্টস থেকে দীর্ঘ সময় বিচ্ছিন্ন হয়ে বা দূরে থেকেছে। দেখা যায় বাংলাদেশের আলোকচিত্রে গার্মেন্টস মূলত: জায়গা পেয়েছে শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরির আন্দোলনে পুলিশি আঘাত ও ভবন বিপর্যয়ের ঘটনা থেকে। ২০০৫ সন থেকে দেশে গার্মেন্টস কারখানায় ভয়াবহ ভবন ধসের বড় রকমের সূত্রপাত ঘটে। তারপর এক এক করে তাজরীন ফ্যাশসন, স্পেকট্রাম থেকে রানা প্লাজা। বৃহৎ ভবন ধস ও অগ্নিকাণ্ডের ফলে নির্দয় গণহত্যা। এক একটি ভবন বিপর্যয় আর লাশের সারি নিশ্চুপ ক্যামেরাকে চাঙ্গা করে দিয়েছে। ২০০০-এর পর থেকে দেখা যায় গার্মেন্টসের মজুরি আন্দোলন আর ভবন বিপর্যয়ের ভেতর দিয়েই মূলত বাংলাদেশের আলোকচিত্রে গার্মেন্টস এক আগ্রহের বিষয় হয়ে ওঠে।
এই ভগ্নস্তুপ আর লাশের অনর্গল উপস্থিতিই কেন প্রবলভাবে রানা প্লাজার অনিবার্য ইমেজ-নিয়তি হয়ে উঠল? তার মানে কী রানা প্লাজার মতো করপোরেট অন্যায়কে এই নয়া উদারবাদী দুনিয়ায় এক গরিব দেশের ক্যামেরা শুধু লাশ আর চুরমার দিয়েই দেখতে থাকবে? এই ক্যামেরা কার ক্যামেরা, কার মনস্তত্ত্ব, কার পরিবেশন?
পরবর্তীতে রানা প্লাজা গণহত্যার পর দুম করেই ‘রানা প্লাজা’ আলোকচিত্র ময়দানের একটা বড় জায়গা দখল করে ফেলে। একে কেবলমাত্র স্মৃতি-সাক্ষ্য আর ঘটনার নথি হিসেবেই দেখা যাচ্ছে না। কারণ রানা প্লাজা নিয়ে পরিবেশিত আলোকচিত্র বৈশ্বিক পরিসরেও এক প্রবল জায়গা নিয়ে দাঁড়ায়। বা হয়তো এভাবেই করপোরেট বিশ্বায়িত দুনিয়া একে জায়গা করে দিয়েছে। রানা প্লাজা গণহত্যার আগে কী আমরা রানা প্লাজা দেখেছি? রানা প্লাজায় যারা নিহত ও নিরুদ্দেশ হয়েছে তাদের কী আমরা আগে দেখিনি কখনো? তাহলে এক গণহত্যার উপস্থাপনের ভেতর দিয়েই কেন রানা প্লাজার ইমেজ প্রতিষ্ঠার বাহাদুরি? দুমড়ানো মুচড়ানো অবকাঠামো আর নির্দয় রক্তস্রোতে। এই ভগ্নস্তুপ আর লাশের অনর্গল উপস্থিতিই কেন প্রবলভাবে রানা প্লাজার অনিবার্য ইমেজ-নিয়তি হয়ে উঠল? তার মানে কী রানা প্লাজার মতো করপোরেট অন্যায়কে এই নয়া উদারবাদী দুনিয়ায় এক গরিব দেশের ক্যামেরা শুধু লাশ আর চুরমার দিয়েই দেখতে থাকবে? এই ক্যামেরা কার ক্যামেরা, কার মনস্তত্ত্ব, কার পরিবেশন? বরেণ্য আলোকচিত্রীদের পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের তাসলিমা আখতার, রাহুল তালুকদার বা আবীর আবদুল্লাহর মতো আলোকচিত্রী যারা রানা প্লাজাকে ক্যামেরার বিষয় করেছেন তাদের কাজ নিরন্তর আমার শিক্ষাগুরু। কিন্তু সেসব আলোকচিত্রে রানা প্লাজার ইমেজ কী নিয়ে উপস্থিত? সেই একই দৃশ্যমানতা, বিপর্যয় আর খুনখারাবি। এমনকি এসব আলোকচিত্রই বিশ্ব দরবারে নানা পুরস্কার ও গগণস্পর্শী সম্মান ও স্বীকৃতিতে ভূষিত। তার মানে আন্তর্জাতিক দরবার আর আলোকচিত্রের ময়দান, বিস্তারিতভাবে বললে পুরস্কারের রাজনীতি হয়তো বাংলাদেশের আলোকচিত্রকে রানা প্লাজার চুরমার আর রক্তস্রোতের ভেতর দিয়েই দেখতে চায়। বা দেখাটা জারি রাখে। এখানে জড়িয়ে আছে ‘অন্যতাকে’ পাঠের সেই উপনিবেশিক কায়দা আর ক্ষমতা সম্পর্কের শ্রেণিপ্রশ্ন। গার্মেন্টস-প্রশ্নকে যা যাবতীয় বাহাসের পরিধি থেকে আড়াল করে শুধুমাত্র ‘দায়িত্বহীনতা’ আর ‘দুর্নীতি’ হিসেবেই দেখতে চায়। রানা প্লাজার আলোকচিত্রে উধাও থেকেছে রাষ্ট্র ও জনগণের উৎপাদনশীলতার সম্পর্ক, শ্রেণিপ্রশ্নের ঐতিহাসিকতা এবং প্রাণ ও প্রকৃতির বিরাজমানতা। মানছি বাংলাদেশের আলোকচিত্রের ময়দান এখনও নিম্নবর্গের যাপিত জীবনের দর্শন ও বীক্ষায় বিকশিত হতে পারেনি। পশ্চিমের চাপিয়ে দেয়া চিন্তাপদ্ধতি আর উপনিবেশিক পরিবেশনা ফানা ফানা করে আপন আওয়াজে এখনো দাঁড়ায়নি বাংলাদেশের ক্যামেরা। এমনই এক বৈষম্য বিশ্বায়িত দুনিয়াতেই রানা প্লাজা তৈরি হয়েছে। চুরমার হয়েছে। আর তাই আমাদের ক্যামেরাগুলোও গর্জে ওঠেছে। এমনকি বিপ্লবী ক্যামেরার লেন্সও খুলে দাঁড়ায়নি উপনিবেশিকতার মোড়ক। রানা প্লাজার ইমেজের পেছনে ঘুরেছে বৈশ্বিক পুরস্কারের দোকান। পুরস্কারের স্বীকৃতির তলায় মূলত: ইমেজের অধিপতি পরিবেশন প্রতিষ্ঠিত ও অনিবার্য করেছে।
ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাটির দেয়াল আর ভগ্নস্তূপের ভেতর দিয়ে হয়তো বাস্তবতার কোনো ভঙ্গি রূপায়িত হয় কিন্তু কোনোভাবেই তা মাটির ঘরবাসী নিম্নবর্গের কাছে নান্দনিক নয়। এই চৌচির আর ভগ্নস্তূপ সে দেখাতে চায় না, ঢাকতে চায়।
ইমেজ ঘিরে ‘নন্দনতত্ত্ব’র তর্ক ও তলানি
উপনিবেশিক আধুনিকতার বিবাদ শিল্পমাধ্যমের নন্দনতত্ত্বের আলাপকে চাপিয়ে দিয়েছে কলম, তুলি থেকে ক্যামেরা অব্দি। চিত্রকলার আলাপ যেহেতু এটি নয়, তারপরও দেখা যায় একটা বড় সময় জুড়ে ভাঙা বেড়ার খড়-মাটির ঘর আর পট্টিলাগানো নৌকার পাল। পোর্টেট আঁকার ক্ষেত্রে কুঁচকে যাওয়া প্রবীণ চামড়া আর হাড্ডিসার শরীর তুলনামূলকভাবে বেশি জায়গা পেয়েছে। আর এসবের ভেতর দিয়ে অন্যকিছুর সাথে পরিবেশিত হয়েছে ‘নান্দনিকতার’ ধরণ। ফেটে চৌচির হয়ে যাওয়া মাটির দেয়াল আর ভগ্নস্তূপের ভেতর দিয়ে হয়তো বাস্তবতার কোনো ভঙ্গি রূপায়িত হয় কিন্তু কোনোভাবেই তা মাটির ঘরবাসী নিম্নবর্গের কাছে নান্দনিক নয়। এই চৌচির আর ভগ্নস্তূপ সে দেখাতে চায় না, ঢাকতে চায়। একে নিজের ব্যর্থতা আর ব্যবস্থার অন্যায্যতা হিসেবেই দেখে। কিন্তু শিল্পের প্রবল ধারায় এই চৌচির আর ভগ্নস্তূপই নান্দনিকতার ব্যাকরণ প্রতিষ্ঠিত করে চললো। অনিবার্য করে তুললো বড় কায়দায়। এই রূপায়ন ও উপস্থাপন সর্বৈব এলিট, বিচ্ছিন্ন আর দেমাগী। কবিতা, গল্প, উপন্যাসকে টানা যেত কিন্তু চলতি আলাপখানি মূলত: দেখাদেখির শিল্পমাধ্যম আলোকচিত্র ঘিরে। দেখাদেখির জায়গা থেকে আলোকচিত্র আর চিত্রকলার মধ্যে কোনো এক মিলের কারণেই চিত্রকলাকে টেনেছি।
এখন কথা হচ্ছে, চিত্রকলার নান্দনিকতার এই উপনিবেশিক রূপায়ণ খারিজ করে কী দাঁড়িয়েছে আলোকচিত্রের নান্দনিকতা? এখনও একটি নিহত ও মুমূর্ষু নদীর ইমেজ নান্দনিক! দীর্ঘ সময় জুড়ে সবুজ ধান ক্ষেত, মেঘে মোড়ানো চিম্বুক পাহাড় আর পাথর বিছানো ঝর্ণাস্নাত নান্দনিক ইমেজ। কিন্তু এই নান্দনিকতার আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় ধানক্ষেত, পাহাড় আর ঝর্ণাস্রোতের উপর অবিরাম জুলুম আর অন্যায়। সিনজেনটা কোম্পানির বিষে যন্ত্রণাকাতর এক হাইব্রিড ধানক্ষেত কীভাবে নান্দনিক হয়। গ্যারিসন সম্প্রসারণের নামে খানখান পাহাড়, পাথর-বাণিজ্যের ফলে রক্তাক্ত ঝর্ণাস্রোতের আহাজারি টের পায় না আমাদের ভীষণ নান্দনিক ক্যামেরাগুলি। পেয়েছে এমন পাবলিক উদাহরণ কোথায়! শিল্পমাধ্যমের নান্দনিকতার উপনিবেশিক ময়দান থেকে একটি প্রশ্ন তোলা যাক রানা প্লাজার ইমেজ কী নান্দনিক?
বস্তিবাসি মানে একটুখানি বস্তির চিহ্ন, মাঝি মানে নিদেনপক্ষে একটা নৌকার ছায়া বা বেশ্যা মানে কোনো সরু গলিপথ। নিম্নবর্গের ইমেজ মানে কোনোভাবেই শুধুমাত্র তার ব্যক্তিসত্তার পরিবেশন নয়।
বলা হয় অনুকরণীয় শিল্পমাধ্যমসমূহের ভেতর আলোকচিত্র কিছুটা সহজসাধ্য। সংবেদনশীলতার সামাজিক চলমানতা ধারণ করে আলোকচিত্র বারবার বাস্তবতার সাইনবোর্ড সামনে টানায়। কিন্তু কোনোভাবেই পরাবাস্তব তর্ক ঝেড়ে ফেলে নয়, বরং আলোকচিত্র খুব কৌশলের সাথেই বাস্তবকে দেখে এক ব্যক্তিগত আহাজারির পরাবাস্তবের মোড়কে। পরাবাস্তবতা রাজনৈতিকভাবেই বিশৃঙ্খল দৃশ্যকে আয়ত্ত করে এবং দুর্ঘটনা ও কাতরানিকে ভাবপ্রকাশের প্রধান তল হিসেবে সাজায়। কিংবা কখনো কখনো বানিয়ে তোলে, কখবোবা অনিবার্য করে ফেলে। বাংলাদেশি আলোকচিত্রে প্রামাণ্যধারা আজ বেশ বলশালী, ইমেজের বাজারমুখী ক্ষমতার ময়দানে বলা যায় দোর্দন্ড। কিন্তু এই প্রবণতা একটা সামাজিক শ্রেণি বিকাশের ব্যাকরণ মানেনি যেন। দুম করেই ভ্রূণ থেকে তরতাজা হাড়-কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। যেন মাঝপথে ফেলে এসেছে বিস্তর ফাঁক ও ফারাক। তুলনামূলকভাবে প্রামাণ্য-আলোকচিত্রের নান্দনিকতাই আরও প্রবলভাবে রাজনৈতিক অবয়ব দাঁড় করায়। আর তাই এটি প্রান্তিক ও অন্যতাকে ঘিরে দাঁড়ায়। দারিদ্র্য ও যৌনতা থেকে নানা সামাজিক নিপীড়ন। উন্নয়ন-বাহাদুরি থেকে বহুজাতিক লুন্ঠন। আত্মপরিচয় তর্ক থেকে শ্রেণিদ্বন্দ্ব। আর তাই আলোকচিত্রের নান্দনিকতার পরিবেশন অনেকটাই রয়ে যায় সমাজের অপেক্ষাকৃত নিম্নবর্গ, অস্পৃশ্য ও নিপীড়িতজনের ভেতর। নিম্নবর্গের কোনো বাস্তবতাকে দুঃখবোধ না প্রতিরোধ হিসেবে দেখা হবে, তা কেবলমাত্র শেষমেষ এক পুস্তকি তত্ত্ব-গরিমা হয়েই দাঁড়ায়। যাপিতজীবনের টগবগ ও জীবনের গতিবিধি সেখানে ‘অনর্থক’ হয়ে যায়। আবার একইসাথে ক্যামেরার মারদাঙ্গা কেবল গরিবের ঘর নয়, ঢুকে পড়ে এলিট ধনীর অন্দরমহলেও। ধনী আর গরিবের ইমেজ পরিবেশন নিশ্চয়ই একইরকম হবে না, কিন্তু একই দর্শন-তল থেকে সমদৃষ্টিসীমার ভেতর থেকে হয় কী? ধনীর ইমেজ পরিবেশনায় তার চারপাশ থাকে না, ব্যক্তি নিজেই সেখানে পুরো ইমেজ-সীমা দখল করে নেয়। যেন এটি অনিবার্য। স্মরণ করুন কোনো কোনো দৈনিকে একটি ছবির ধাঁধা থাকে। যেখানে পরিচিত সিনেমা শিল্পী ও সুপারস্টারদের মুখচ্ছবিকে কেটে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয়। একটি চোখ, বা মুখের কোনো অংশ, শুধুমাত্র ঠোঁট বা নাক এরকম কোনো অংশ। একটি নাক, চোখের চাহনি বা ঠোঁটের হাসি দেখে প্রমাণ করতে হয় সেটি কার ছবি। এর জন্য পুরস্কারও থাকে। তার মানে কখনো কখনো কোনো কোনো ইমেজ শুধুমাত্র ব্যাক্তির মুখের কোনো একটি খন্ডিত অংশও হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু সেক্ষেত্রে কী ইমেজের পরিবেশন না ব্যক্তির সামাজিক শ্রেণি ক্ষমতা বেশি প্রধান হয়ে ওঠে? ঠিক অপরদিকে নিম্নবর্গের ইমেজ তুলনামূলকভাবে তার চারপাশ নিয়ে হাজির হয় ক্যামেরার বাস্তবতার ভেতর দিয়ে। বস্তিবাসি মানে একটুখানি বস্তির চিহ্ন, মাঝি মানে নিদেনপক্ষে একটা নৌকার ছায়া বা বেশ্যা মানে কোনো সরু গলিপথ। নিম্নবর্গের ইমেজ মানে কোনোভাবেই শুধুমাত্র তার ব্যক্তিসত্তার পরিবেশন নয়। অধিকাংশ সময়েই ব্যক্তির আত্মপরিচয় নিশ্চিহ্ন হয়ে নিম্নবর্গের ইমেজ হয়ে ওঠে কোনো পেশাজীবীতার কাহিনি বা গোষ্ঠীগত যন্ত্রণা। কিন্তু নিম্নবর্গ আর এলিট ধনীর ময়দান থেকে বাংলাদেশের ক্যামেরা কী মধ্যবিত্তের ইমেজ পরিবেশন করতে পেরেছে। ইমেজের ভেতর দিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালি বা বাঙালি ভিন্ন অপরাপর জাতির যাপিতজীবনের বাস্তবতা খুব কী চোখের নাগালে আছে? তাহলে প্রশ্ন ওঠা তো স্বাভাবিক আমাদের ক্যামেরা কার চোখে দেখে? ক্যামেরার শ্রেণি অবস্থান কী? এই ক্যামেরার ভেতর দিয়ে পরিবেশিত নান্দকিতা কোন শ্রেণি পরিসর উসকে দেয়? কোনটাকে আড়াল করতে চায় আর কোনটাকে চাঙ্গা করে?
ক্যামেরার কাছে বাস্তবতা তো সবসময় এমনই নাগাল, যা তার পেছনের ব্যক্তিটি ধারণ করেছে এবং উপস্থিত মুহূর্তকে বন্দি করবার একটা দুর্মর কাতরতা নিয়ে হাজির হয়েছে। অন্যতাকে ধারণ করবার এবং ইমেজ হিসেবে পরিবেশন করবার পুরো প্রক্রিয়াতে ব্যক্তি তার শ্রেণিপরিচয় উৎরে যাওয়ার কসরৎ করে। বোঝাতে যায় ইমেজ সার্বজনীন। ইমেজের এই সার্বজনীন পরিবেশনায় তুলনামূলকভাবে প্রামাণ্য-আলোকচিত্রীরা অধিক পারদর্শী। বিচক্ষণ, রাজনৈতিকভাবে সচেতন এবং কখনোবা প্রকট। তারা রপ্ত করেন কীভাবে সামাজিক সংবেদনশীলতাকে ইমেজে বন্দি করতে হয়। কীভাবে অপাঙক্তেয় শ্রমিক বস্তিও শিল্পের নান্দনিক ব্যাকরণ তৈরি করে। এ-নিয়ে কখনো সংঘাত ও বাহাস হলেও পরাবাস্তবতার চিন্তাসূত্র খসে পড়ে না। প্রামাণ্য-আলোকচিত্রের ভেতর দিয়ে সময় ও সমাজ-সম্পর্কের খুনসুটিগুলো আরো এক দীর্ঘ ঐতিহাসিক দূরত্ব নিয়ে হাজির থাকে, যা পরাবাস্তব লেন্সের ভেতর দিয়ে আলোকচিত্রীর নিজস্ব বাস্তবতা। বাংলাদেশের আলোকচিত্রে গার্মেন্টস এবং শ্রমিক-যন্ত্রণা, আরো বিস্তারিতভাবে বললে চলতি আলাপের রানা প্লাজার ইমেজ তেমনি এক পরাবাস্তব ছবি। গার্মেন্টস ঘিরে, বিশেষত রানা প্লাজার আলোকচিত্রগুলোর গরিষ্ঠভাগকেই আমার কাছে প্রামাণ্য-আলোকচিত্রীদের কাজ মনে হয়েছে। দৃশ্যকল্প, আলো-ছায়া, শাটার স্পিড, ফোকাস, বিন্যাস ও কারিগরি সব কিছু মিলিয়ে রানা প্লাজার ছবিগুলোকে এক অসহনীয় গণহত্যার পরাবাস্তব ইমেজ মনে হয়। রানা প্লাজা নিয়ে কাজ করা প্রায় প্রতিজন প্রণম্য আলোকচিত্রীর দীর্ঘ ক্যামেরা-পরিভ্রমণ, রাজনৈতিকতা ও সামাজিক প্রণোদনা এসব ইমেজ পরিবেশনে অনেকটাই সঙ্গী হতে হয়েছে। আর তাই দেখা যায় একটা যন্ত্রের ভেতর দিয়ে বাস্তবতার পরিবেশন তাই শেষতক ব্যক্তির নিজস্ব ইমেজ-ইশতেহার হিসেবেই ঘোষিত হয়েছে। প্রমাণ করতে চেয়েছে এটি সাক্ষ্য এবং একই সাথে নান্দনিক। এমনতো হয়নি এই ইমেজ ধারণে (বন্দিকরণে) ব্যক্তি আলোকচিত্রী তার অস্তিত্বকে খান খান করে দিয়েছে বা এমনও তো হয়নি আলোকচিত্রীর শ্রেণিচ্যুতি ঘটেছে। সামাজিক শ্রেণি-দ্বন্দ্বের চক্রে থেকেই ক্যামেরার লেন্স রানা প্লাজার ভাঙচুর আর রক্তস্রোতে দেখেছে। ক্যামেরার পেছনের চোখ, মগজ, হাত ও শরীর নিদারুণভাবে সতর্ক থেকেছে। এই সতর্কতা থেকেই কিন্তু দুনিয়া কাঁপানো সব ইমেজের জন্ম! এই সতর্ক মুহূর্তে বিদ্যমান ভাঙচুর বাস্তবতার ভেতরেও ব্যক্তি আলোকচিত্রীকে অনেক ধরণের কারিগরি কসরৎ করতে হয়েছে। করতে হয়েছে অনেক ভাগ বিভাগ, যোগ আর বিয়োগ। আলোকচিত্রী তার ফ্রেমে কতটা বন্দি করবেন এবং কীভাবে কতটা আলো-আঁধারিতে এটি পুরোটাই তার নিজস্ব রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার বিষয়। কেউ নিশ্চয়ই এমন প্রশ্ন তুলবেন না যে, কবিতা রচনাতেও তো বাক্য-শব্দ-ব্যাঞ্জনা-মাত্রা-ছন্দ বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কিন্তু কবিতা আর আলোকচিত্র নিশ্চয়ই এক নয়। মাধ্যম কি কারিগরি কোনোভাবেই। রানা প্লাজার আলোকচিত্রে দেখা যাওয়া ভাঙচুর আর রক্তযন্ত্রণাও সতর্কভাবেই মাঠে ময়দানের ক্ষমতার তর্ক থেকেই পরিবেশিত।
বেরুতে না পারা মানে গণ্ডিকে তোলপাড় করে দেয়া, কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা বিচ্ছিন্নতাবোধ টিকিয়ে রাখা নয়। রানা প্লাজার ইমেজ নির্মাণে সর্বজয়ী ক্যামেরাগুলি ভাঙচুরের যতটা গভীরে গেছে, ততটাই যেন বিচ্ছিন্ন হয়েছে যাপিত জীবনের গভীরতা, তৈরি হয়েছে পরাবাস্তব সব দুর্ধর্ষ ইমেজ।
রোদ-বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া পাসেপোর্ট আকৃতির নারী ও পুরুষের ছবি। রানা প্লাজা গণহত্যার পর নিখোঁজ এসব শ্রমিকের ছবিগুলো দেয়ালে সেঁটেছেন তাদের প্রিয়জনেরা। রাহুল তালুকদার এসব ক্ষয়াটে ছবির ভেতর দিয়েই ‘ফেডেড হিস্ট্রি অব দ্য লস্ট’ শিরোনামে রানা প্লাজার গল্পটি বলেছেন। এছাড়াও ‘কলাপস অব রানা প্লাজা’ সহ আরো অনেক ছবি আছে তার। ভাঙচুরের ভেতর নিহত নিথর নারী-পুরুষের জড়াজড়ির ভঙ্গিতে থাকা ‘ফাইনাল এম্ব্রেস বা শেষ আলিঙ্গ ‘ (নামগুলি অন্যদের দেয়া হয়তো) আলোকচিত্রটি দুনিয়াজুড়ে এলিট ইমেজ-জগতে তোলপাড় তুলে দেয়। এমনকি আবীর আবদুল্লাহর আহত শ্রমিকের হাসপাতাল জীবন যেখানে আহতের চোখ থেকেও বিবর্ণ হয়েছে চারধারের দেয়াল বা এন্ড্রু বিরাজের পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে গার্মেন্টস শ্রমিক রাহেলার সংগ্রাম। গার্মেন্টস নিয়ে, বলা ভাল রানা প্লাজা নিয়ে নিশ্চিতভাবে অগণিত ইমেজ পরিবেশিত হয়েছে। এমনকি অনেক আলোকচিত্রী-সাংবাদিকেরা জীবনঝুঁকি নিয়ে রানা প্লাজাকে চলমান গার্মেন্টস বাণিজ্যের সামনে এক প্রশ্নহীন সাক্ষি হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। রোহেত আলী রাজীব, এএম আহাদ, আবদুল্লাহ অপু, আবদুল্লাহ আল মমিন, আবীর আবদুল্লাহ, আল ইমরান গর্জন, এমরান হোসেন, অ্যান্ড্রু বিরাজ, আনোয়ার হোসেন জয়, আসাদুজ্জামান প্রামাণিক, অনকিতে প্রান্তর, অভিক আদনান সিদ্দিকি, বুলবুল আহমেদ, ফরিদ আহমেদ, ফিরোজ আহমেদ, হাসান রাজা, ইন্দ্রজিৎ ঘোষ, জাহাঙ্গীর আলম, জীবন ঘোষ, কলিম সান্টু, কামরুল ইসলাম রতন, খান মো. নজরুল ইসলাম, খোরশেদ আলম রিংকু, কেএম আসাদ, এমএ বাতেন জয়, এমআর হাসান, মাহমুদুল হোসেন অপু, মামুনূর রশীদ, মো.সৌরভ, মেহেদি হাসান, মোহাম্মদ আসাদ, মঈন আহমেদ, মমিন, মনিরুল আলম, মঞ্জুরুল করিম, মাফি হোসেইন, মুনির উজ জামান, নাসিরুল ইসলাম, নয়ন কুমার, নজরুল মাসুদ, ওমর ফারুক, পলাশ খান, রাজিব ধর, রাশেদ সুমন, আহমেদ সুমন, সাজিদ হোসেন, সজল আহমদে, সালমান সাঈদ, সানাউল হক, শফিকুল আলম, শাহাদাত পারভেজ, শেখ এনামুল হক, সজিব আহমেদ, সানি রামানি, শুভ্র কান্তি দাস, সৈয়দ জাকির হোসাইন, জাহিদুল করিম সেলিম, জায়িদ ইসলাম ও জিয়া ইসলামের মতো অনেকেই তাদের স্মৃতি-সাক্ষ্য নিয়ে প্রদর্শনীরও আয়োজন করেছেন। রানা প্লাজার স্মৃতিতে ‘১১৩৪ সংখ্যা নয় প্রাণ’ শিরোনামে আয়োজিত প্রদর্শনীতে আবীর আবদুল্লাহ, এমদাদুল হক, আয়েশা সুলতানা, অয়ন রেহাল, জয়দেব রোয়াজা, কে এম আসাদ, কবীর আহমেদ সামুস চিশতী, মাহমুদ হোসেন অপু, মোহাম্মদ হাসানুর রহমান, পারভেজ আহমেদ, প্রমথেশ দাশ পুলক, রাহুল তালুকদার, ঋতু সাত্তার, শিমুল সাহা, সুলেখা চৌধুরী, শুভ্র কান্তি দাশ, তুশিকুর রহমান, ইয়াসমিন জাহান নূপুর, দেবাশীষ সোম, তাসলিমা আখতার, দিলারা বেগম জলি ও মুনেম ওয়াসিফদের শৈল্পিক উপস্থাপন প্রতিবাদের ভেতর দিয়ে বারবার যেন রানা প্লাজার পরাবাস্তব ইমেজকেই প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে বাস্তবতা পঠিত ও অনুশীলিত হয়েছে ব্যক্তি শিল্পীর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার বাস্তবতায়। এমনকী রানা প্লাজার উল্লিখিত ইমেজগুলিতে নান্দনিকতা বন্দি হয়েছে খুবই সতর্ক কায়দায়, মুন্সীয়ানা ও কৌশলকে বগলদাবা করে। কিন্তু তা কোনোভাবেই ব্যক্তির মুগ্ধতাবোধ আর বাস্তবতাকে বন্দি করবার দুর্মর ডাকসাইটে মোহ থেকে বেরুতে পারেনি। বেরুতে না পারা মানে গণ্ডিকে তোলপাড় করে দেয়া, কোনোভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া বা বিচ্ছিন্নতাবোধ টিকিয়ে রাখা নয়। রানা প্লাজার ইমেজ নির্মাণে সর্বজয়ী ক্যামেরাগুলি ভাঙচুরের যতটা গভীরে গেছে, ততটাই যেন বিচ্ছিন্ন হয়েছে যাপিত জীবনের গভীরতা, তৈরি হয়েছে পরাবাস্তব সব দুর্ধর্ষ ইমেজ। এসব ইমেজ যন্ত্রণার প্রকরণ পরিবেশন করে, কিন্তু গোপন করতে চায় ক্যামেরার সামনে পেছনের যাবতীয় ক্ষমতার গণিত।
গার্মেন্টসে ধনীদের কাপড় আর গরিবের লাশ তৈরি হয়
নিশ্চিতভাবে একজন আলোকচিত্রীর বাস্তবতা নির্মাণ ও পরিবেশনের ক্ষমতা ও কারিগরি বেশি। যা আবার শৈল্পিক মুন্সীয়ানা হিসেবেও আখ্যায়িত হয়। ক্যামেরা এতোটাই ক্ষমতা ধারণ করে যে, একটা বাইরের দুনিয়ার বাস্তবতাকে সে নিজের ভেতরে টেনে ধরে চোখের পলকে বাস্তবতার ইমেজ তৈরি করে দেয়। কখনো এটি সাক্ষ্য, কখনো বা উপস্থাপনের কারিগরি কখনো বা শিল্পের দায়। পরিবেশনের নানা আয়োজন ও ব্যঞ্জনায় যে বাস্তবতা মূলত চাপিয়ে দেয়ার তর্ককেই হাজির করে ও জারি রাখে। আলোকচিত্রের প্রবল জায়গাটি হলো নির্মিত বাস্তবতার প্রতি আমাদের মেনে নেয়া বা গ্রহণ করাকে প্রভাবিত করে তুলে। আলোকচিত্রের এ অধিপতি অবস্থান মহাবয়ানের এক ভ্রান্ত চটক তৈরি করে এবং দুনিয়ার আমূল বিকাশের প্রশ্নে নিশ্চুপ থাকে। এ-জায়গায় দাঁড়িয়ে বাংলাদেশের গার্মেন্টস আলোকচিত্র বা চলতি আলাপের ভঙ্গিতে বললে রানা প্লাজা ইমেজও আমাদের সামনে চলমান ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করবার চাইতে একে সংগ্রহের প্রতিই বেশি অনুরক্ত করে তুলতে চেয়েছে। নয়াউদারবাদী দুনিয়ার গার্মেন্টস বাণিজ্যের তর্ককে দেশের নিম্নবর্গের উৎপাদনশীলতা ও শ্রেণিপ্রশ্ন হিসেবে দেখেনি। কেন দুনিয়ায় গার্মেন্টসের মতো এমন অন্যায্য ব্যবস্থা টিকে আছে বা চালু হয়েছে এমনতর মৌলিক প্রশ্ন আমাদের ইমেজে আসেনি। গার্মেন্টস এক অনিবার্য নিয়তি এটিকে মেনেই এখানকার বৈষম্যমূলক আচরণ ও রক্তক্ষরণগুলো ক্যামেরার ফ্রেমে বন্দি হয়েছে। তাও যখন প্রত্যক্ষভাবে চুরমার, আগুন ও লাশ দৃশ্যমান হয়েছে। গার্মেন্টসশ্রমিকের নিত্যদিনের দিনযাপনের ভেতর দিয়ে নয়।
ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আজকের দুনিয়ার করপোরেট কোম্পানি সকলেই কেবলমাত্র বাণিজ্য আর দখলের স্বার্থে টেনেহিঁচড়ে ফালি-ফালি করেছে এই ইতিহাস। আদিবাসী কি বাঙালি নিম্নবর্গের বস্ত্রকারিগরকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্র গড়ে তোলেনি পোশাকের ন্যায্য শিল্প। বরং রাষ্ট্র নয়াউদারবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় নিজের মাথা নুইয়ে রেখেছে।
কেন সমতল থেকে পাহাড় বাংলাদেশের নানা গ্রাম থেকে কোনো মেয়েকে গার্মেন্টসে কাজ করতে আসতে হয়? এটি নিশ্চয়ই নারীর সূচিশিল্প বা বয়ন কারিগরির প্রতি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি নয়। ব্যবস্থাটা এমনই চরম যেখানে গ্রাম থেকে একটি মেয়েকে গার্মেন্টসে টেনেহিঁচড়ে আনা হয়। এটি নয়াউদারবাদী যুগের উপনিবেশিক দাস-বাণিজ্যের নয়া রূপ। গ্রামের পর গ্রামকে বহুজাতিক উন্নয়ন মারদাঙ্গায় থ্যাতলে দিয়ে উৎপাদনের সাথে নারীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে। অধিক খাদ্য উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা, আধুনিক কৃষি, নদী শাসন, বিদ্যুৎ উৎপাদন, শিল্পায়ন, নগরায়ন আর করপোরেট পর্যটনের নামে এই উৎখাত প্রক্রিয়া জারি আছে। সেখানে একজন নারী তার চারপাশকে অন্যায়ভাবে বদলে ফেলতে দেখেছে। তার সকল ধরণের প্রবেশাধিকারকে আটকে ফেলা হয়েছে। একমাত্র উন্মুক্ত ক্ষেত্র শহরের গার্মেন্টস। বলা হয়ে থাকে বিশেষ এক জাতের কার্পাস তুলার আদিভূমি মধুপুর গড়। কার্পাসের সেই স্মৃতি নিয়ে এখনো বেঁচে আছে ভাওয়াল গড়ের কাপাসিয়া। পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার এক কেন্দ্রীয় তুলামহাল হিসেবে টেনে এনেছিল দুনিয়ার বহিরাগত বিলিতি বণিকদের। বস্ত্র-ইতিহাসের সূক্ষ্ম বুনন ঐতিহ্য মসলিন জন্ম নিয়েছিল শীতলক্ষ্যা অববাহিকায়। মসলিনের মাকু ধরে জামদানি বুটি মেলেছে এ অঞ্চলেই। নরসিংদী, টাঙ্গাইল, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, কুষ্টিয়া, মৌলভীবাজার, সিলেট, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, সুনামগঞ্জ, কক্সবাজার, কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা, শেরপুর অঞ্চলের মতো বিশেষ বিশেষ তাঁত ঐতিহ্য নিয়েই গড়ে উঠেছে বাংলার করুণ বস্ত্র-আখ্যান। এ আখ্যানের পরতে-পরতে আছে রক্ত আর দুঃশাসনের দাগ। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আজকের দুনিয়ার করপোরেট কোম্পানি সকলেই কেবলমাত্র বাণিজ্য আর দখলের স্বার্থে টেনেহিঁচড়ে ফালি-ফালি করেছে এই ইতিহাস। আদিবাসী কি বাঙালি নিম্নবর্গের বস্ত্রকারিগরকে মর্যাদা দিয়ে রাষ্ট্র গড়ে তোলেনি পোশাকের ন্যায্য শিল্প। বরং রাষ্ট্র নয়াউদারবাদী বৈশ্বিক ব্যবস্থায় নিজের মাথা নুইয়ে রেখেছে। আর তাই রাষ্ট্রের গরিব নাগরিকদের তরতাজা লাশের বিনিময়ে তৈরি হচ্ছে একটার পর একটা ‘নয়াউদারবাদী টি-শার্ট’। মানুষের অধিকার আর শখের বিন্যাস আটকে যাচ্ছে বহুজাতিক ‘পোশাক ব্র্যান্ডিং’ বাণিজ্যের ঘেরাটোপে। Reebok, Mothercare, Lee, Wrangler, Eagle, Decathon, Lafuma, JC Penny, Walmart, Kmart, OSPIG, Docken, NAB, Tommy Hilfiger, Addidas,Decathon, Phillip Morris প্রভৃতি করপোরেট বস্ত্রবণিকই আজ নিয়ন্ত্রণ করছে বস্ত্রবাজার ও বস্ত্রকারিগরি। দেশীয় বস্ত্রপরিসর থেকে উচ্ছেদ হওয়া গরিব নারীর নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে আজ এসব করপোরেট গার্মেন্টসে কাজ করে কারখানা ধসে লাশ হয়ে গুম হয়ে যাওয়া।
রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ গার্মেন্টসকে ‘শিল্প’ বলছে। তার মানে এখানে মালিক-শ্রমিক শ্রেণিসম্পর্কটি বিরাজিত। কিন্তু গার্মেন্টস শিল্পের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত আমাদের ক্যামেরার লেন্স কী এই শ্রেণি সম্পর্ক আন্দাজ করেছে? নাকি তার পাঠ ভিন্ন। রাজনৈতিক দার্শনিকতার তর্কে বাংলাদেশকে কেউ পুঁজিবাদী সমাজ কাঠামো, কেউ বা আধা সামন্ততান্ত্রিক, কেউ বা ধনতান্ত্রিক কেউ আবার গণতান্ত্রিক বলতে আগ্রহী। বাংলাদেশের গার্মেণ্টস নিয়ে তৈরি হওয়া ইমেজে এই তর্কটি অস্পষ্ট। এক পুঁজিবাদী সমাজ ভেতর দিয়ে প্রবাহিত লেন্স মূলত: কী ধরণের ইমেজকে বাস্তবতার কাছাকাছি নিবে? নাকি এসব ইমেজ সামাজিক সম্পর্ক ও মেরুকরণগুলো আড়াল করে বারবার ভগ্নস্তূপ আর লাশের ভেতর দিয়ে ‘করপোরেট সামাজিক দায়বদ্ধতাকেই’ শুধু প্রশ্ন করবে? এটি কি শুধুমাত্র কতক এজেন্সির জুয়াখেলা? রানা প্লাজার ইমেজ কী তাহলে রাষ্ট্রের অস্তিত্বকে গুম করে দিতে চায় নাকি রাষ্ট্রের সাথে এক আপাত বিচ্ছিন্ন সম্পর্কের ভেতর দিয়ে পরাবাস্তবতার শাটার স্পিডে এক এলিট ইমেজকে বৈধ করে তুলতে চায়। রানা প্লাজার ইমেজে এজেন্সিকে যত বেশি খুঁজে পাওয়া তত বেশি রাষ্ট্র অনুপস্থিত। বলা ভাল নিরুদ্দেশ। রাষ্ট্রে বিদ্যমান সংগঠনভিত্তিক রাজনৈতিক চর্চার প্রভাববলয় আর তাদের লুন্ঠন ও দুনীর্তি কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ হলেও রাষ্ট্রের শ্রেণিপ্রশ্ন কি দার্শনিকতার তালাশ এখানে নেই। এটি খুব জোরদার হবে যদি ভাঙচুর বা লাশ ছাড়াই রানা প্লাজার ইমেজ দাঁড়ায়, যেখানে দিনানুদৈনিকতার লাশের স্রোত আর নির্দয় ভাঙচুর বয়ে যায়। চুরমার হয়ে যাওয়া গ্রাম জনপদ আর ব্যক্তি সম্পর্কগুলো যখন খান খান হয়ে যায়। নাড়িপোতা জন্মমাটি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে বহুজাতিক কারখানার দাস হতে হয় এখনও। সেই নীল চাষ, চা চাষ, তামাক চাষ, হাইব্রিড ফসল চাষ থেকে শুরু করে এখনো আমাদের ক্যামেরা বারবার ভাঙচুর আর রক্তস্রোতের ভেতর দিয়ে বাস্তবতাকে পাঠ করতে চায়? আলো-আঁধারির কারিগরিতে নিম্নবর্গের সাথে বিচ্ছিন্ন এক প্রবল ইমেজ পরিবেশন করতে চায়? কোনো ধরণের জাতীয়তাবাদী গন্ধ না টেনেই বলছি, আমাদের ক্যামেরা কেন আমাদের হয়ে ওঠে না? আমাদের দর্শন, বীক্ষা, রাজনৈতিকতা আর দুনিয়া পাঠের ঐতিহাসিক বিস্তার থেকেই তো রানা প্লাজা আমাদের দিনযাপনের অংশ। সেই ইমেজ তো আমাদের যাপিত জীবন থেকেই পরিবেশিত হওয়া জরুরি। কোনো এজেন্সির চোখরাঙানি, বুদ্ধিবৃত্তিক বাহাদুরি বা একরোখা এলিট বিচ্ছিন্নময়তাকে টিকিয়ে রাখবার স্বার্থে নয়।
আমি অমীমাংসিত নৈতিকতা আর নিরপেক্ষতার তর্ককে এই আলাপে টানছি না। কিন্তু রানা প্লাজার ইমেজ যখন দুমদাম করে একটার পর একটা আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের ময়দান করে চলে তখন এই ইমেজের দিকে আরেকভাবে চোখ যায়।
পুরস্কারের ঝলকানি ও ইমেজের মেধাস্বত্ত্ব
চলতি আলাপখানি ইমেজের দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক এবং নিম্নবর্গের বিচ্ছিন্নতার তল স্মরণে রেখেছে। রানা প্লাজার ইমেজেও দেখতে পেয়েছে কত কারসাজি আর কারিগরি। অসহিষ্ণু শাটার, ঢেকুর তোলা ফ্ল্যাশ, নির্দয় কম্পোজিশন, আলো-আঁধারির জাদুময়তা তৈরির উন্মাদনা, স্বার্থপর ফোকাস কত কী। সবকিছু ছাপিয়ে রানা প্লাজার সকল আলোকচিত্রী আমার কাছে নমস্য, কারণ তারা অনেকেই কিছুটা সময়ের জন্য হলেও হয়তো তার পেশাগত প্রয়োজন বা একেবারেই স্বেচ্ছায় একটা ঘটনার কাছাকাছি আগলে ছিলেন। যেখানে দুনিয়া ব্যাখাময় নয় শুধু, একেবারে উদাহরণ হয়ে ছিল। অধিকাংশ ক্যামেরাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা স্তূপ আর আহাজারির ভেতর, প্রজাতি হিসেবে মানুষের বিচিত্র সম্পর্কের টানাপোড়েনকে নিজেদের ক্যামেরার দখলে নিতে যারপরনাই মরিয়া ছিলেন। আমি অমীমাংসিত নৈতিকতা আর নিরপেক্ষতার তর্ককে এই আলাপে টানছি না। কিন্তু রানা প্লাজার ইমেজ যখন দুমদাম করে একটার পর একটা আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা ও পুরস্কারের ময়দান করে চলে তখন এই ইমেজের দিকে আরেকভাবে চোখ যায়।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় আলোকচিত্র প্রতিযোগিতা নাকি সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি। ৮৭ হাজার ছবির মধ্যে পুরস্কার জিতে নেয় রাহুল তালুকদারের রানা প্লাজার ছবি ‘ফেডেড হিস্টরি অব দ্য লস্ট’। ২০১৫ সালে রাহুল জিতেন সনি ওয়ার্ল্ড ফটোগ্রাফি অ্যাওয়ার্ড। শুধু তাই নয়, রানা প্লাজা নিয়ে তার ‘কলাপস অব রানা প্লাজা’ ওয়ার্ল্ড প্রেস ফটোর মতো দুনিয়া কাঁপানো পুরস্কারও জিতেছে। তাসলিমা আখতারের রানা প্লাজা আলোকচিত্র পায়নি এমন আন্তর্জাতিক খেতাব ও সম্মান কম আছে। ওয়ার্ল্ড প্রেস থেকে শুরু করে জার্মানির লিড অ্যাওয়ার্ড, টাইমস থেকে শুরু করে জার্মানির স্টার্ন সাময়িকী কোথায় নেই সেই ‘শেষ আলিঙ্গন’। রানা প্লাজা নিয়ে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশি আলোকচিত্রীরা আরো নানা পুরস্কার ও খেতাব পেয়েছেন, সেটাই স্বাভাবিক, এক্ষেত্রে সবকটির খবর না রাখার জন্য চলতি আলাপ আপাদমস্তক ক্ষমাপ্রার্থী।
দারিদ্র্যর পর বন্যা আর মঙ্গা কিছুটা আলোকচিত্র ময়দান দখল করলেও সিডর এবং আইলার পর আন্তর্জাতিক আলোকচিত্র ময়দানে বাংলাদেশের ইমেজগুলি বদলে যায় দ্রুত। স্বীকার করছি এর ভেতর আরো নানা গুরুত্বপূর্ণ এবং অবশ্যই ভীষণভাবে উল্লেখ করবার মতো আমাদের গর্বের আলোকচিত্র আছে। আমি নিজে সেসবের তীব্র অনুরাগী এবং তর্কপ্রিয় শিক্ষার্থী। কিন্তু রানা প্লাজা গণহত্যার পর বাংলাদেশের আলোকচিত্র প্রবল হারে কেন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও খেতাব লাভ করল? তার মানে কী আন্তর্জাতিক দুনিয়া, আরো মোটা দাগে বললে পশ্চিমি দুনিয়া বাংলাদেশকে রানা প্লাজার ভেতর দিয়েই দেখতে চেয়েছে? একটা দেশের বস্ত্র ইতিহাসের ঐতিহাসিকতা থেকে নয়। যে জনপদ দুনিয়ার বুকে মসলিন, জামদানি ও বেইন তাঁতের জন্ম দিয়েছে তার আহাজারি থেকে নয়। এই ভাঙচুর আর লাশের ইমেজ একেবারেই একটি গরিব দেশের নিরুত্তাপ ক্ষমতা কাঠামো আর এজেন্সি নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর রূপকেই প্রমাণ করে তুলে। আলোকচিত্র যদি সাক্ষ্য হয়, রানা প্লাজার গরিষ্ঠভাগ ইমেজ সেই বাস্তবতাই নির্মাণ করেছে। এক সার্বভৌম রাষ্ট্রের চাইতেও এজেন্সির ব্যাটাগিরিকে। এখন প্রশ্ন হলো যদি বাংলাদেশের এই বাস্তবতাই হয়, রাষ্ট্রের চেয়েও এজেন্সি কর্তৃত্ববাদী হয় তখন ক্যামেরা আর কী করতে পারে? রানা প্লাজার আলোকচিত্র তো আর ‘সিসি ক্যামেরার ফুটেজ’ নয়। এখানে বাস্তবতাকে রাখঢাক করবার কিংবা নির্মাণ-বিনির্মাণের বিষয় থাকে। একজন আলোকচিত্রী কত আর চুরমার হয়ে যাওয়া এক লাশের স্তূপে লেন্স ঢেকে বসে থাকতে পারেন। এটি হয় না। তাসলিমা আখতার আলোকচিত্র নিয়ে তাঁর একটি লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, আলোকচিত্র হচ্ছে তার ভাষা ও হাতিয়ার। নিঃসন্দেহে আলোকচিত্রীদের স্ব-স্ব রণনীতি ও রণকৌশল আছে। আর তাই রানা প্লাজার ইমেজ পরিবেশনার কারিগরি ও উপস্থাপনকলায় ভিন্নতা তৈয়ার হয়েছে। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন কায়দায় পরিবেশিত সব আলোকচিত্রই শেষতক নয়াউদারবাদী বাস্তবতার এক পরাবাস্তব ইমেজকে বৈধ করতে চেয়েছে। এমনকী যখন দুড়দাড় করে এসব ইমেজ বৈশ্বিক আলোকচিত্র ময়দানে জায়গা করছে বা এসব ইমেজকে পুরস্কৃত করা হচ্ছে তখন রানা প্লাজা দরবারের ভেতর দিয়ে এক বিশ্বায়িত বৈষম্যের দুনিয়া দেখবার আর সব ইমেজ নিদারুণভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। বলা ভাল যাপিত জীবনের বাস্তবতার দৃশ্যময়তা আড়াল হয়ে যায়। রানা প্লাজার নিখোঁজ শ্রমিকের মতই।
রোদ-বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া রাহুল তালুকদারের ছবি বা তাসলিমা আখতারের ‘শেষ আলিঙ্গন’। এই লাশ আর নিখোঁজ মানুষেরা আর অস্তিত্বময় ব্যক্তি হিসেবে থাকেনি, বৈশ্বিক ইমেজ-বারান্দায় শেষতক তাসলিমা আখতার কিংবা রাহুল তালুকদারের আলোকচিত্র হয়ে ঝুলে আছে।
ক্যামেরার ভেতর দিয়ে একজন আলোকচিত্রী কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা ঘটনার উপর তার এক নির্মম দখল তৈয়ার করেন। যেন সেই ফ্রেমবার বন্দী হওয়া জগত তার মালিকাধীন। সম্পদের ব্যক্তিগত মালিকানার আদি তর্ক থেকেই আমরা সরাসরি রানা প্লাজার ইমেজের মালিকানা প্রশ্নে চলে যাচ্ছি। রানা প্লাজার শত কোটি ইমেজের মালিকানা আদতে কার? যে-নিষ্ঠুর নির্মম বাস্তবতাকে ফ্রেমবন্দি করে আজ আমাদের নানা পুরস্কার জুটছে আর বাংলাদেশের এক নয়া বৈশ্বিক চেহারা দাঁড়াচ্ছে এই দৃশ্যময়তার কী কোনো মালিকানা আছে? তাহলে আলাপটি যদি আরো রাখঢাকহীন কায়দায় ইমেজের মেধাস্বত্ত্ব তর্কে নিয়ে যাই সেটি কেমন হয়? সন্তান-স্বজন খুঁজে না পাওয়া পরিবার যখন লাশটি পেয়েছে, কী দুঃসাহসে লাশের দখল নিতে চেয়েছে। লাশ হলেও একটি পরিচয়, অস্তিত্বের এক পরিচিত ব্যাঞ্জনা। কিন্তু আমাদের ক্যামেরাও যখন সেই লাশ আর আহাজারিকে বন্দি করেছে তখন তার উপর এক আপাত দূরত্বে দখলিস্বত্ব তৈয়ার করেছে। রোদ-বৃষ্টিতে ক্ষয়ে যাওয়া রাহুল তালুকদারের ছবি বা তাসলিমা আখতারের ‘শেষ আলিঙ্গন’। এই লাশ আর নিখোঁজ মানুষেরা আর অস্তিত্বময় ব্যক্তি হিসেবে থাকেনি, বৈশ্বিক ইমেজ-বারান্দায় শেষতক তাসলিমা আখতার কিংবা রাহুল তালুকদারের আলোকচিত্র হয়ে ঝুলে আছে।
তর্কটি পুরনো, আদিবাসীদের ছবি কীভাবে তোলা হবে কিংবা কীভাবে পরিবেশিত হবে? দৈনিক পত্রিকায় ধর্ষিতের ছবি যাবে কী যাবে না? লাশের ছবি থাকবে কী থাকবে না? একটি ফ্রেমে কম্পোজিশনের জন্য আমি একটি লাশ কোনো বিশেষ রঙের কাপড় দিয়ে ঢেকে দিব কি না? বা কোন ইমজেকে রঙিন আর কোন ইমেজকে সাদা-কালো হিসেবে পরিবেশন করা হবে। কিংবা নিজের অভিজ্ঞতার কাছাকাছি থেকে ইমেজ প্রায় সর্বদাই ব্যক্তির মুগ্ধতাকে প্রকাশ করে বলে দেখা যায়, রাষ্ট্রের নিষ্পেশনের বিরুদ্ধে নিম্নবর্গের কোনো প্রতিবাদ খুব কায়দা করে তার ‘বীরপনাকে’ প্রবলভাবে উপস্থাপন করে। কথা হলো রানা প্লাজার লাশ কী নিখোঁজ মানুষেরা কেউ কী চায় তাদের এমন উপস্থাপন? আমাদের ক্যামেরা কী লাশের কাছে পূর্ব অনুমতি নিতে পারে? কিংবা নিখোঁজ নিরুদ্দেশ মানুষের ইমেজ পরিবেশনে কীভাবে তার সম্মতি নেয়া হয়? আমরা ইমেজের মালিকানার প্রশ্নকে এখনও সম্মতি, বাণিজ্য তর্ক, পুরস্কার-রাজনীতি আর পণ্যসর্বস্বতার নৈতিকতার জায়গাতে আটকে রেখেছি। শুধুমাত্র বাণিজ্য বিস্তার আর কর্পোটায়নের তর্ক দিয়ে সব বাহাস ঢেকে দিলে ইমেজের মেধাস্বত্ত্বের মৌলিক আওয়াজ নিরুদ্দেশ হতে বাধ্য। আমরা নিশ্চয়ই এমনকি কেউ চাই না। বাংলাদেশের ক্যামেরা এটি কখনোই চায় না। আমি নিরন্তর বিশ্বাস করি এইসব ক্যামেরা শ্রেণিসূত্রকে প্রশ্ন করবে, নিম্নবর্গের যাপিত জীবনের ভেতর দিয়ে পরিবেশিত হবে রানা প্লাজার ইমেজ। যেখানে কেবল পরাবাস্তবতার কারিগরি নয়, ব্যক্তি নিজেও ইমেজের অংশীদার।